সারদা কেলেঙ্কারিতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের আঁচ পেতে আগামী সপ্তাহ থেকেই কলকাতার তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কয়েক জন ব্যবসায়ী ও ক্লাবকর্তাকে সমন পাঠানো শুরু করবে সিবিআই। রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের নামও রয়েছে সেই তালিকায়। আজ সিবিআই সদর দফতর সূত্রে এই খবর জানানো হয়েছে।
সবে বুধবার এই মামলায় তাদের প্রথম চার্জশিটটি পেশ করে সিবিআই। সেখানে রয়েছে কুণাল ঘোষ, সুদীপ্ত সেন এবং দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের নাম। সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেসল মামলাটিতে এ ছাড়াও চার সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। স্বাভাবিক ভাবেই এর পরে প্রশ্ন ওঠে, রাজ্য পুলিশের তদন্তকারীরা যে ছোট বৃত্তের মধ্যে আটকে ছিলেন, সিবিআই-ও কি সেখানেই আটকে থাকবে? সুপ্রিম কোর্ট যে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত করতে বলেছিল, তার কী হবে? সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এ দিন সিবিআই সূত্রে বলা হয়েছে, “প্রথম চার্জশিটে প্রভাবশালী কারও নাম না থাকায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আমাদের সব তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়ে তবেই চার্জশিট পেশ করতে হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে কাউকে গ্রেফতার করতে চাইছি না।” ওই সূত্রটি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যে বা যাঁরাই যুক্ত থাকুন না কেন, তাঁদের সকলের বিরুদ্ধেই আমরা মামলা দায়ের করব।”
সিবিআই সূত্রটি জানাচ্ছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তাঁরা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের জাল খুলতে চাইছেন। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ, প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারের গ্রেফতারির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন সিবিআই-এর ওই সূত্র। যে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস-এর মামলায় কালই প্রাথমিক চার্জশিটটি পেশ করেছে সিবিআই, তার সঙ্গে রেলের সংস্থা আইআরসিটিসি-র সম্পর্ক নিয়ে ওই চার্জশিটে কোনও উল্লেখই নেই। সিবিআই সূত্রটির ব্যাখ্যা, “আমরা বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে যে তদন্ত করেছি, তাতে চার্জশিট পেশ করার মতো তথ্য পাইনি। এ ব্যাপারে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। সেই সময়ে রেলের উচ্চপদে কর্মরত কয়েক জন কর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।” তাঁদের কেউ কেউ এখন পশ্চিমবঙ্গে উচ্চপদে রয়েছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছে সিবিআই।
সারদা তদন্তে এখনও পর্যন্ত জেরা করে পাওয়া তথ্য থেকে যে সব প্রভাবশালীর নাম উঠে এসেছে, ষড়যন্ত্রে তাঁদের ভূমিকা ও আর্থিক লেনদেনের দিকটি এখন খতিয়ে দেখছে সিবিআই। তদন্তকারী অফিসারদের যুক্তি, সারদা তদন্তের ক্ষেত্রে এত তাড়াহুড়ো করা সম্ভব নয়। কারণ একই সঙ্গে প্রতারণা, ষড়যন্ত্র, আর্থিক নয়ছয়, বিশ্বাসভঙ্গের মতো বিভিন্ন আইনে মামলা চলছে। আবার বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও আইনি ভাষা মেনে আদালতে পেশ করতে হবে। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “সিবিআই তদন্ত শুরুর আগে রাজ্য পুলিশের সিট ও ইকনমিক অফেন্স সেল তদন্ত চালিয়েছিল। যার ফলে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়ায় আরও দেরি হচ্ছে। আগের তদন্তকারী দলের থেকে যে সব নথিপত্র পাওয়া গিয়েছে, তা আবার ঠিক করে আইনমাফিক ঢেলে সাজতে হচ্ছে। মাত্র তিন মাসে এই গোটা তদন্ত সেরে ফেলা সম্ভব নয়। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট কাজ শুরু করেছে গত বছরের এপ্রিলে। সেই তুলনায় আমরা মাত্র তিন মাস হাতে পেয়েছি।”
তা হলে কাল ব্যাঙ্কশাল কোর্টে প্রাথমিক চার্জশিটটি পেশ করা হল কেন? সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, সুদীপ্ত-কুণাল-দেবযানীর গ্রেফতারের পরে ৯০ দিন প্রায় হয়ে এসেছে। এক বার এই সময় পেরিয়ে গেলে তাঁরা জামিনের আবেদন করে জামিন পেয়েও যেতেও পারেন। কিন্তু তদন্তের জন্যই তাঁদের হেফাজতে রাখা প্রয়োজন। এই সূত্রে সিবিআই স্পষ্ট করে দিয়েছে, কুণাল ঘোষ যে বারবার দাবি করছেন, তিনি সারদার আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি কিছুই জানতেন না, সেটা তারা মানছে না। সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসারদের বক্তব্য, কুণালও সারদার টাকা থেকে ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হয়েছিলেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তবে এ কথা ঠিক, শাসক দলের মধ্যে তিনিই একমাত্র লাভবান হননি।
সিবিআই-এর এক শীর্ষকর্তা আজ বলেন, “এই চার্জশিট দিয়েই মামলা শুরু হল। এর পরে তদন্ত এবং আদালতে শুনানি পাশাপাশি চলবে। নির্দিষ্ট সময়ে নতুন চার্জশিট পেশ করা হবে। ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৭৩ (৮) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তদন্তকারী সংস্থা চার্জশিট পেশের পরেও তদন্ত চালিয়ে যেতে পারে।” ওই সিবিআই কর্তা জানান, সেই বফর্স থেকে হালের টুজি স্পেকট্রাম বা কয়লা কেলেঙ্কারি যে কোনও তদন্তেই প্রথম চার্জশিটে সব অভিযুক্তের নাম ছিল না। তদন্ত যত এগিয়েছে, আদালতে শুনানি চলেছে, প্রাথমিক চার্জশিটের পরিপূরক হিসেবে আরও চার্জশিট পেশ করা হয়েছে। ধীরে ধীরে মূল পাণ্ডাদের নাম উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা সাংসদ, এমনকী নামী শিল্প সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্তা হয়েও তাদের জেল খাটতে হয়েছে। সারদার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।
সুদীপ্ত-কুণাল-দেবযানী ছাড়াও সারদার ভাইস-প্রেসিডেন্ট সোমনাথ দত্ত, সংস্থার ডিরেক্টর মনোজ নেগেল ও সুদীপ্তর চালক অরবিন্দ চৌহানকে রাজ্য পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সিবিআইয়ের চার্জশিটে তাঁদের নাম নেই। একই ভাবে সিবিআই নিজে যাঁদের গ্রেফতার করেছে, সেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব-কর্তা দেবব্রত সরকার, তৃণমূল নেতা তথা প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা রজত মজুমদার এবং ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবালের নাম ওই চার্জশিটে নেই। দেবব্রত-রজত-সন্ধিরের ক্ষেত্রে আরও সময় রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের পর ৯০ দিন সময় পার হতে আরও দু’তিন সপ্তাহ বাকি রয়েছে। এঁরা যাতে জামিন না পান, তা নিশ্চিত করতে ঠিক সময়েই চার্জশিট পেশ করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy