Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বিবেকে বেসামাল তৃণমূল

সুব্রতর পর সরব সাধন, নরম রাজ্যপালও

২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তীব্রতর হল যাদবপুর-যন্ত্রণা। শুক্রবার রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্রী গীতশ্রী সরকারের ‘অহিংস’ প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাতেই সুব্রতবাবুর বক্তব্য খণ্ডন করতে রাজ্যপালের সম্মানের প্রশ্ন তুলে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কিন্তু রাত পোহাতেই ফের নেত্রীর বিড়ম্বনা বাড়ালেন আর এক প্রবীণ মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর নাম না করে রাজ্যের ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রী সাধনবাবু বুঝিয়ে দিলেন, উপাচার্যের পদত্যাগ করা উচিত বলেই মনে করেন তিনি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তীব্রতর হল যাদবপুর-যন্ত্রণা।

শুক্রবার রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্রী গীতশ্রী সরকারের ‘অহিংস’ প্রতিবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাতেই সুব্রতবাবুর বক্তব্য খণ্ডন করতে রাজ্যপালের সম্মানের প্রশ্ন তুলে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কিন্তু রাত পোহাতেই ফের নেত্রীর বিড়ম্বনা বাড়ালেন আর এক প্রবীণ মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর নাম না করে রাজ্যের ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রী সাধনবাবু বুঝিয়ে দিলেন, উপাচার্যের পদত্যাগ করা উচিত বলেই মনে করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত দুই বিরোধী নেতা বাবুল সুপ্রিয় এবং সূর্যকান্ত মিশ্র। অন্য দিকে, রাজ্যপালও এ দিন সুর নরম করে জানালেন, সমাবর্তনের দিন ওই ছাত্রী তাঁর সম্মানহানি করেননি। বরং ‘অত্যন্ত বিনম্র ভাবে’ই সে দিন শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান করেছিলেন গীতশ্রী।

দিন কয়েক আগে যাদবপুরের তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু বলেছিলেন, সারদার টাকা নয়ছয়ে অভিযুক্তদের শাস্তি চান তিনি। এ বার পরপর দু’দিন যাদবপুর নিয়ে দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে মন্তব্য করে বসলেন সুব্রতবাবু ও সাধনবাবু। মাস তিনেক আগে যাদবপুর অশান্ত হয়ে ওঠার সময় থেকেই উপাচার্যের পাশে রয়েছে রাজ্য সরকার। নানা মহলের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও স্থায়ী উপাচার্য পদে নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন অভিজিৎবাবু। আর এ দিন তাঁর উদ্দেশেই সাধনবাবু বলেছেন, “কেউ না চাইলে পদ আঁকড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। সেই পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত। প্রত্যেকেরই আত্মসম্মান থাকা উচিত! আমি যদি বুঝি কেউ আমাকে পছন্দ করছে না, তা হলে আমি চলে যাব। আমি চেয়ারে বসে থাকব কেন?”

সাধনবাবুর এই মন্তব্য নিয়ে এ দিন তোলপাড় চলেছে তৃণমূল তথা সরকারের অন্দরে। কারও কারও প্রশ্ন, গীতশ্রীর মতো এক জন এসএফআই নেত্রীর আচরণের প্রতি কেন নরম মনোভাব নিচ্ছেন পোড়খাওয়া নেতা সুব্রতবাবু? তবে কি সারদা কাণ্ড-সহ নানা ঘটনায় সরকার যখন কোণঠাসা, তখন পরিকল্পনা করেই এক এক জন নেতা বেসুরে গাইছেন? তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “হাওয়া এখন খুব এলোমেলো। সবাই মনে হচ্ছে জল মাপতে চাইছেন!”

উত্তরবঙ্গ সফর সেরে এ দিনই কলকাতায় ফিরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর নির্দেশ না আসায় শনিবার রাত পর্যন্ত দলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও মন্তব্য করতে চাননি শীর্ষ নেতারা। শুক্রবারের মতো এ দিনও মুখ খুলতে চাননি শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তবে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ বলছেন, দল এবং সরকারের অবস্থানের পক্ষেই সকলে যাতে কথা বলেন, তার জন্য একটা নির্দিষ্ট রূপরেখা বেঁধে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ঘরোয়া আলাপচারিতায় তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার ক্ষোভ, “এক এক দিন এক এক জনের বিবেক জেগে উঠবে, আর বিড়ম্বনায় পড়তে হবে দলের সাধারণ কর্মী-নেতাদের! এঁরা সকলেই ভোটে জিতেছেন মমতার ছবি নিয়ে। বিবেক কি ওঁদের জিতিয়েছে?”

বিরোধীরা কিন্তু বলছেন, নানা কেলেঙ্কারি এবং বিতর্কে জেরবার শাসক দলে বিবেক জাগ্রত হওয়াটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। সুগত পথ দেখিয়েছেন। সেই পথে হেঁটেছেন সুব্রত। তার পর সাধন। এ বার আরও অনেকেই মুখ খুলবেন। কারণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থান বহু নেতারই পছন্দ নয়। নেতৃত্বের ভয়ে এত দিন তাঁরা চুপ ছিলেন। কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান যেমন বলেছেন, “তৃণমূলে যাঁরা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, তাঁদের বলেছিলাম চুপ করে থাকবেন না। সুগত, সুব্রতরা মুখ খুলেছেন। এর পরে আরও অনেকে খুলবেন। তৃণমূল তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।”

যে উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার তাঁকে সরায়নি এবং যার ফলে তাদের পদে পদে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে এ দিন ফের মুখ খুলেছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর বক্তব্য, “সমাবর্তনের আগেই আচার্যকে চিঠি দিয়ে উপাচার্যকে সরানোর দাবি করেছিলাম। আগেই উপাচার্যকে সরিয়ে দিলে এত অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়ানো যেত।”

গীতশ্রীর ‘প্রতিবাদ’কে গোড়া থেকেই কড়া সুরে বিঁধে আসছিল রাজ্য বিজেপি। তবে উপাচার্যের বিরুদ্ধেও সরব কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা রাজ্যের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর কথায়, “আমি অভিজিৎবাবু হলে কবেই পদত্যাগ করতাম। উপাচার্যের কি কোনও আত্মসম্মান নেই!” আজ, রবিবার তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে যাদবপুরের বিষয়ে কথা বলবেন বলেও জানিয়েছেন।

ঘনিষ্ঠ মহলে তৃণমূল শীর্ষ নেতাদের অনেকেই মেনে নিচ্ছেন, উপাচার্যকে না সরালে যাদবপুরে স্বাভাবিকতা ফেরা আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু সেই পদক্ষেপ করতে গেলেও যন্ত্রণা বেড়েই চলবে। কেন? রাজ্যের এক প্রথম সারির মন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “যে উপাচার্যকে দু’মাস আগে স্থায়ী ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে, এখন তাঁকে সরাতে গেলে বার্তা যাবে, ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন এবং বিরোধীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করা হল! উপাচার্য নিজে থেকে সরে গেলে তখন অন্য কথা।”

কিন্তু উপাচার্য সে পথে হাঁটবেন, এমন সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত দূর অস্ৎ। এ দিন তিনি বলেছেন, “আমি ঠিক আছি। পাবলিক এখনও আমাকে চায়!” সাধনবাবু অবশ্য এ কথাও বলেছেন, ছাত্রছাত্রীরা যে ভাবে শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান করেছেন তা ঠিক হয়নি। বস্তুত, সমাবর্তন-বিতর্ক নিয়ে সরকারের অবস্থান কী, সে সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ইতিমধ্যেই পেয়েছেন দল তথা সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীরা। সেই সুরেই ফিরহাদ শুক্রবার বলেছিলেন, “প্রতিবাদ করতে চাইলে ছাত্রছাত্রীরা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে না এসেও তা করতে পারতেন। কিন্তু রাজ্যপালকে অসম্মান করাকে শোভন বলা যাবে না!” তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এ দিন গঙ্গাসাগর যাওয়ার পথে হলদিয়ায় রাজ্যপাল বলেছেন, “সংবাদপত্রে দেখেছি, মেয়েটি ক্ষমা চেয়েছে। সুতরাং এই অধ্যায় এখন শেষ হয়ে গিয়েছে।” সাগরে পৌঁছে ফের তিনি বলেন, “কেউ শংসাপত্র নিতে পারে, না-ও নিতে পারে, সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু ওই ছাত্রী আমার সঙ্গে কোনও দুর্ব্যবহার করেনি, অত্যন্ত বিনম্র ভাবে সে (শংসাপত্র) প্রত্যাখ্যান করেছে। মঞ্চে তাকে আমি তিন বার বলেছিলাম শংসাপত্র নিতে। সে নেয়নি। তখন আমি ছাত্রীটিকে ‘গো ব্যাক’ বলেছি, ‘গেট আউট’ বলিনি।”

ফোনে যোগাযোগ করা হলে গীতশ্রী জানান, রাজ্যপালকে অসম্মান করার কোনও উদ্দেশ্য যে তাঁর ছিল না, তা তিনি আগেই বলেছেন। সে দিন কি ‘গেট আউট’ বলেছিলেন রাজ্যপাল? গীতশ্রীর কথায়, “কী বলেছিলেন, ৭২ ঘণ্টা পরে আর তেমন মনে নেই। তবে সম্ভবত উনি ‘গো ব্যাক’ বলেননি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE