Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পিছু হটব না, হুমকি তৃণমূলের

সারদায় ফেঁসে বাধা সংস্কারে: জেটলি

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাত মাস পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হল নরেন্দ্র মোদীর। এবং সেখানে দু’জনের কথা হল কি না স্বাস্থ্য নিয়ে! শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রপতি ভবনের ভোজসভায় মুখোমুখি হয়ে প্রাথমিক কুশল জিজ্ঞাসার পরেই মমতার কাছে প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, আপনার শরীর কেমন আছে? ভোজসভার এই সৌহার্দ্য ভোজবাজির মতো উড়ে গেল ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই! বরং ফের যুদ্ধং দেহি মূর্তিতে অবতীর্ণ দুই শিবির!

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৩
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাত মাস পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হল নরেন্দ্র মোদীর। এবং সেখানে দু’জনের কথা হল কি না স্বাস্থ্য নিয়ে! শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রপতি ভবনের ভোজসভায় মুখোমুখি হয়ে প্রাথমিক কুশল জিজ্ঞাসার পরেই মমতার কাছে প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, আপনার শরীর কেমন আছে?

ভোজসভার এই সৌহার্দ্য ভোজবাজির মতো উড়ে গেল ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই! বরং ফের যুদ্ধং দেহি মূর্তিতে অবতীর্ণ দুই শিবির! আজ বণিকসভা ফিকি-র মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংস্কার প্রশ্নে তৃণমূলকে নিশানা করে তোপ দাগলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বিমায় বিদেশি লগ্নি, কয়লা খনি বণ্টন থেকে পণ্য পরিষেবা কর প্রতিটি আর্থিক সংস্কারে বাধা দেওয়ার জন্য গোটা দেশের শিল্পপতিদের সামনে তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তুললেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। জেটলি অবশ্য সরাসরি তৃণমূলের নাম নেননি। সংস্কারের একাধিক বিলে বিরোধীদের বাধার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এই রাজনৈতিক বাধার কারণ হল ন্যক্কারজনক চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে একটি রাজনৈতিক দলের কয়েক জন নেতা জড়িয়ে পড়েছেন। সেখান থেকে নজর ঘোরাতেই তারা এ সব করছে।”

কেন এতটা আক্রমণাত্মক হলেন জেটলি? বস্তুত চলতি অধিবেশনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিল আটকে গিয়েছে বিরোধীদের বাধায়। এমনিতে সংস্কার প্রশ্নে কংগ্রেসকে পাশে পাওয়ার আশা থাকলেও তৃণমূলের কৌশলে বিরোধীরা একজোট হওয়ায় সমস্যায় পড়ছে সরকার। এই পরিস্থিতিতে আক্রমণকেই পাল্টা হাতিয়ার করেছে বিজেপি। একই সঙ্গে সংস্কারের গতি যাতে রুদ্ধ না হয়, সে জন্য অন্য পথও নেওয়ার কথা ভাবছে তারা। বিজেপি সূত্রের খবর, বিমা ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ বিদেশি লগ্নি এবং কয়লাখনি বণ্টন নিয়ে জট কাটাতে প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্স জারির কথা ভাবছে সরকার।

শনিবার সকাল দশটায় ফিকি-র মঞ্চে দাঁড়িয়ে জেটলি যখন তৃণমূলকে নিশানা করছেন, তখনও দিল্লি ছাড়েননি মমতা। তিনি তখন সাউথ অ্যাভিনিউয়ের বাসভবনের লনে বসেছিলেন। কলকাতার বিমান ধরতে বেরোবেন বলে স্নান করে তৈরি। খবর আসে, জেটলি তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন। মমতা জানতে চান, কী বলেছেন জেটলি? পুরোটা শুনে দৃশ্যতই ক্ষিপ্ত মমতা রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে কথা বলেন। রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনকে নির্দেশ দেন, এখনই পাল্টা আক্রমণে যেতে হবে। কী বলতে হবে, তা-ও বলে দেন তিনি।

দুপুরেই কলকাতা ফেরার কথা ছিল ডেরেকের। কিন্তু দলনেত্রীর নির্দেশে ফেরা পিছিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন তিনি। জেটলিকে পাল্টা নিশানা করে ডেরেক বলেন, “একটাও বিল পাশ করাতে না পেরে অর্থমন্ত্রী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। একা তৃণমূল নয়, আটটি বিরোধী দল একজোট হয়ে বিমা-কয়লা বিলের বিরোধিতা করছে। শুধু তৃণমূলকে ভিলেন বানানো হচ্ছে!” সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে তৃণমূলের এই বিরোধিতার সম্পর্ক উড়িয়ে জেটলিকে ডেরেকের পাল্টা হুমকি, “কাদা ছুঁড়লে আমরাও কাদা ছুঁড়ব। কেলেঙ্কারির কথা বললে আমরাও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (জেটলি যে বোর্ডের উপ-সভাপতি ছিলেন) কেলেঙ্কারি টেনে বের করব। আমরা জানি কে পিছন থেকে ক্রিকেট বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।”

আর এই তরজা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট। রাষ্ট্রপতি ভবনের ভোজসভায় দেখনদারি সৌজন্য আর রাজনৈতিক বাস্তবের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। মুখ্যমন্ত্রী গত কালই প্রথম প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তুমুল জল্পনাও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু রাত পোহাতেই দুই দলের কথাবার্তায় স্পষ্ট, মোদী-মমতা সাক্ষাতেও সব কিছু মিটমাট হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের একটি সূত্রের বক্তব্য, মমতার সঙ্গে মোদীর কুশল বিনিময়ের অর্থ এই নয় যে, মদন মিত্রকে বাঁচানোর জন্য সিবিআইকে উদ্যোগী হতে হবে। সিবিআই স্বাধীন ভাবে তদন্ত চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে নাক গলালে অফিসারেরা তাঁকেই সম্মান করবেন না।

আজ সকালে ফিকি-র বার্ষিক সাধারণ সভায় যাওয়ার আগেই জেটলি ঠিক করে গিয়েছিলেন, তিনি তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন।

ঘনিষ্ঠ মহলে তা জানিয়েও দেন তিনি। বিজেপি নেতারা একটা বিষয়ে এক মত যে, সিবিআই তদন্তে মদন মিত্রের গ্রেফতারে চাপে পড়েই সংসদে গোলমাল শুরু করেছে তৃণমূল। বিজেপির বক্তব্য, গত এক সপ্তাহ ধরে রাজ্যসভায় অচলাবস্থা তৈরির পিছনে তৃণমূলই মূল উদ্যোক্তা। পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি)-এও পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি আদতে রাজনৈতিক। এ ব্যাপারে অন্য কোনও রাজ্যকেই পাশে পায়নি তারা। এই অবস্থায় তৃণমূলকে আক্রমণ করা দরকার। সেই পথে হেঁটে আজ জেটলি নিজে থেকেই তৃণমূলের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। সংস্কারের বাধা দেওয়ায় বামেরাও তাঁর আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি। বামেদের কটাক্ষ করে জেটলি বলেন, “বামেরা মতাদর্শগত লড়াইয়ে হেরে গিয়েছে। তা সে রাশিয়া হোক, চিন কিংবা পশ্চিমবঙ্গ। কিউবার পরে রাজ্যসভাই ওঁদের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র!” তার পরেই তৃণমূলের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের প্রধান দুই দলই সংস্কার বিরোধী। এর মধ্যে একটি দল এখন চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকে নজর ঘোরাতেই তারা সংসদে সব বিলে বাধা দিচ্ছে।”

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ২০১২ সালে এই ফিকি-র বার্ষিক সাধারণ সভায় হাজির হয়েই মমতা শিল্পপতিদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের জন্য। আজ সেই ফিকি-র শিল্পপতিদের সামনেই মমতার দলকে ‘সংস্কার-বিরোধী’ আখ্যা দিলেন জেটলি।

গত বার দিল্লি সফরে এসে আগামী মাসে কলকাতায় ‘বিশ্ব বাংলা শিল্প সম্মেলনে’ আসার জন্য জেটলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা। জেটলি এক কথায় রাজি হয়ে যান। এখন জেটলি চাইছেন, ওই সম্মেলনে গিয়ে সংস্কারের কথা বলেই মমতাকে পাল্টা চাপে ফেলবেন। একই সঙ্গে শিল্পপতিদের সঙ্গেও বৈঠক করে তিনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাবেন। যেটা কার্যত আজ ফিকি-র মঞ্চ থেকেই শুরু করেছেন তিনি। জেটলি আজ শিল্পপতিদের অনুরোধ করেন, “কোনও একটি রাজ্য পণ্য-পরিষেবা করের মতো সংস্কারে বাধা দিলে আমার পরামর্শ হল, সেখানে গিয়ে এই বিষয়টি তুলুন। রাজি করান। দরকারে জনমত গড়ে তুলে চাপ তৈরি করুন।”

বিজেপির একটি সূত্রের কথায়, “যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্যের একে অন্যকে প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গের যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে মমতারই বেশি দরকার মোদীকে।” বিজেপির যুক্তি, সারদা কেলেঙ্কারির জেরে সিবিআই তদন্ত ছায়া ফেলেছে তৃণমূলের উপর। একের পর এক মমতা-ঘনিষ্ঠ নেতা গ্রেফতার হচ্ছেন। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর তৃণমূল সাংসদের সঙ্গে বাংলাদেশি জামাত-জঙ্গিদের যোগসূত্রের অভিযোগও উঠেছে। ফলে দায় এখন মমতারই।

তৃণমূল অবশ্য বসে নেই। পাল্টা তারা জানিয়েছে, বিজেপির এই সম্মিলিত আক্রমণে তারা পিছু হঠবে না। ডেরেক বলেন, “তৃণমূল কোনও গোপন সমঝোতায় যাবে না।

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় গিয়ে বলেছিলেন, সারদার টাকা বর্ধমান বিস্ফোরণে ব্যবহার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিমন্ত্রীই সংসদে জানান, এমন কোনও প্রমাণ নেই। ওঁরা এখনও তৃণমূলের আসল চেহারা দেখেননি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam arun jaitley derek o'brien tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE