Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হাতজোড় করলাম, গাড়ির কাচ তুলে ধাঁ পর্যবেক্ষকই

ভোটকেন্দ্রের বাইরে তখন তুমুল প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলেন এক দল বৃদ্ধ। সেটা দেখেও স্থবিরের মতো লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশ অফিসারেরা! যেন কিছুই কানে যাচ্ছে না!

পর্যবেক্ষক পিয়ালি সেনগুপ্ত। —নিজস্ব চিত্র।

পর্যবেক্ষক পিয়ালি সেনগুপ্ত। —নিজস্ব চিত্র।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

ভোটকেন্দ্রের বাইরে তখন তুমুল প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলেন এক দল বৃদ্ধ। সেটা দেখেও স্থবিরের মতো লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশ অফিসারেরা! যেন কিছুই কানে যাচ্ছে না!

বিকেল প্রায় চারটে। এইচ এ ব্লকের কমিউনিটি সেন্টারের ভোটকেন্দ্রের ভিতরে স্থানীয় বাসিন্দাদের চেনা মুখ একটিও নেই! তার জায়গায় রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু বহিরাগত যুবক। তাদের কথাবার্তা আর ইভিএম মেশিনে ঘনঘন বোতাম টেপার কর্কশ শব্দ বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। আর অসহায় এক দল বৃদ্ধ পুলিশের দৃষ্টি আর্কষণের জন্য পরিত্রাহি চিৎকার করে যাচ্ছেন!

ঠিক তখনই যেন ‘ত্রাতা’-র মতো দেখা দিল গাড়িটা। এইচ এ ব্লকের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা দিলীপ দাসের কথায়, ‘‘কালো রঙের বড় গাড়ি। তাতে লেখা ‘অবজারভার’। তাকে পাহারা দিয়ে পুলিশের একটি গাড়ি। হাতের সামনে যেন চাঁদ পেলাম! মনে হল, গন্ডগোলের খবর পেয়ে নিশ্চই ত্রাতার ভূমিকা নিতে এসেছেন পর্যবেক্ষক।’’ চোখের সামনে বড় রাস্তা ছেড়ে কালো গাড়ি ঢুকে পড়ল ব্লকের রাস্তায়।

কিন্তু গাড়িটা তো থামতেই চাইছে না! প্রায় হুশ করে বেরিয়ে যেতে চাইছে ভিড়টাকে সরিয়ে! পুলিশ এবং ব্লকের বাসিন্দাদের জটলায় এলাকাটা তখন বেশ জমজমাট। ফলে চালককে বাধ্য হয়েই কমাতে হল গতি। ৭৫ বছরের দিলীপবাবু বলে চলেন, ‘‘এই সুযোগে আমরা গাড়িটাকে ঘিরে নিই। দেখি কালো কাচ। ভিতরে পিছনের আসনে একজন কেউ বসে আছেন।’’ বৃদ্ধের দল সেই জানালার সামনে গেলেও প্রথমে কাচ নামাননি ভিতরের যাত্রী। দিলীপবাবু জানান, তাঁরা বার কয়েক টোকা মারার পরে কাচ নামে। দেখা যায়, একজন মহিলা বসে। ব্লকের অন্য এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘মহিলা দেখে আমরা আরও উৎসাহ পেয়ে যাই। তাঁকে বারবার নেমে পরিস্থিতি নিজে চোখে দেখার অনুরোধ জানাই।’’

কিন্তু তাতে লাভ হল কই! দিলীপবাবুদের অভিযো‌গ, তাঁদের আকুতিতেও ওই মহিলা পর্যবেক্ষক সে দিন ওখানে গাড়ি থেকে নামেনইনি!

প্রশাসন সূত্রে খবর, সে দিন সল্টলেকে এক জন মহিলা পর্যবেক্ষক ছিলেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে থাকা রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের যুগ্মসচিব পিয়ালি সেনগুপ্ত। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে এইচ এ ব্লকের বাসিন্দারাও জানতে পারেন, গাড়িতে ছিলেন পিয়ালিদেবীই। সে দিনের ঘটনা নিয়ে এইচ এ ব্লকের অনেকেই মুখ খুললেও দিলীপবাবু ছাড়া কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁদেরই একজন বলেন, ‘‘সে দিন এতজন বয়স্ক লোক হাতজোড় করে অনুরোধ করতে থাকেন ওই পর্যবেক্ষককে। তাঁকে বলা হয়, ‘আমাদের অভিযোগ মেনে নিতে হবে না। আপনি নিজে নেমে ভিতরে গিয়ে দেখুন কী হচ্ছে’। কিন্তু, উনি সবটুকু শুনে বলে দিলেন, ‘না, না। আমার পক্ষে নামা সম্ভব নয়।’ বলেই কাচ তুলে চলে গেলেন!’’ তার বেশ কিছু ক্ষণ পরে নিজেদের কাজ সেরে সদর্পে বেড়িয়ে গেল ওই যুবকের দল।

দিলীপবাবুর বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলি জেতার জন্য বহিরাগতদের ঢোকাতেই পারে। কিন্তু যে সরকারি অফিসারেরা ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁদের এমন ভূমিকা কেন? তাঁর কথায়, ‘‘সে দিন একবার গাড়ি থেকে নেমে বুথে গেলেই তো উনি দেখতে পেতেন, ভিতরে কী চলছে? তিনি তো পুলিশকে ডেকেও বুথের ভিতরে যাওয়ার কথা বলতে পারতেন।’’ অন্য এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘পুলিশ নিশ্চুপ! রাজনৈতিক নেতাদের এই আস্ফালন। আমলারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বলতে পারেন, সাধারণ অসহায় মানুষ কোথায়, কার কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাবে?’’

যাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, সেই পিয়ালিদেবী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘যা রিপোর্ট দেওয়ার, আমি কমিশনকে দিয়েছি।’’। কমিশনকে দেওয়া তাঁর রিপোর্টে কি সে দিন পড়ন্ত বিকেলে এক দল বয়স্ক মানুষের আর্তির কথা লেখা আছে? জানা যায়নি। তবে, বৃহস্পতিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী কমিশনার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বিধাননগরের যে ৯টি বুথে পুনর্নিবাচনের কথা ঘোষণা করেছেন, সেই তালিকায় নেই এইচ এ কমিউনিটি সেন্টারের নাম!

দিলীপবাবু এ দিন জানান, ভোটের দিন সকাল থেকেই বার বার বুথে হানা দেওয়ার চেষ্টা করছিল অজানা-অচেনা একগাদা মুখ। অপরিচিত মুখগুলোকে দেখেই সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন অনেকে। পরিস্থিতি বুঝে ব্লকের ২০-২৫ বছরের বাসিন্দাদের একটা অংশ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাতে কিছুটা কাজ হচ্ছিল। একদল বৃদ্ধের আপ্রাণ প্রতিরোধের মুখে নাগাড়ে ছাপ্পা মারতে পারছিল না বহিরাগতের দল।

কিন্তু সমস্যা হয় অন্যত্র। অনেকে বুথমুখোই হচ্ছিলেন না। ভয়ে। দুপুর গড়াতেই জমা হচ্ছিল অচেনা যুবকের দল। বাইকে, অটোয়, গাড়িতে। সংখ্যায় অনেক বেশি। বিকেল চারটে নাগাদ প্রবীণদের যাবতীয় প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো উড়িয়ে তারা ঢুকে পড়ল বুথে। ব্লকের কমিউনিটি সেন্টারের দু’টি বুথই তখন ফাঁকা। পুলিশের সামনে কমিউনিটি সেন্টারের পিছনের দরজা দিয়ে বুথে ঢোকে বহিরাগতের দল। হুমকির মুখে বুথ ছাড়েন বিরোধী দলের পোলিং এজেন্ট। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ছাপ্পা-পর্ব সেরে বুথ ছাড়ে দলটি। আর গোটা সময়টা উপস্থিত পুলিশের কাছে বার বার অনুরোধ করেও প্রত্যাখ্যাত প্রবীণদের শেষ আশা ছিলেন পর্যবেক্ষক। কিন্তু তিনিও মুখ ফিরিয়ে চলে যান!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE