হাতিপোতার এখানেই ছিল জমিদারের কাছারি বাড়ি। (ইনসেটে) হাতিপোতায় শরৎচন্দ্রের মূর্তি। ফাইল চিত্র।
ভারতবর্ষের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে ‘দেবদাস’ শব্দটি পরিচিত। অদ্ভুত, স্বপ্নময় প্রেমের এক জাদুময়ী হাতছানি এই ‘দেবদাস’ কাহিনীতে।
২০১৭-তে চলে গেল দেবদাস’-এর শতবর্ষ। অগোচরে। অনাদরে।
শরৎচন্দ্রের অল্প বয়সের রচনা ‘দেবদাস’। অল্প বয়স বলতে পরিণত লেখক হয়ে ওঠার আগে। লেখা শুরুর সময় বিতর্কিত। তবে জানা যায় প্রকাশনার সন। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার কর্ণধার ছিলেন প্রমথনাথ ভট্টাচার্য। প্রমথবাবু এবং শরৎচন্দ্রের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ‘দেবদাস’ প্রকাশের জন্য শরৎচন্দ্রকে প্রমথনাথবাবুই প্রথম বলেন। শরৎচন্দ্র এক কথায় রাজি হয়েছিলেন, এমনটা বলা শক্ত।
শরৎচন্দ্র এক চিঠিতে প্রমথনাথ বাবুকে লেখেন, ‘দেবদাস ভাল নয় প্রমথ, ভাল নয়। ওটা ছাপা হয় তা আমার ইচ্ছা নয়। ‘দেবদাস’ নিও না, নেবার চেষ্টাও কোরো না। ওটা ইমমর্যাল’।
বাংলা ১৩২৩ সাল। শরৎচন্দ্র তখন রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গন)। সুযোগ এল। এ বার প্রমথবাবু অন্য পথ অবলম্বন করলেন। ধরলেন শরৎচন্দ্রের মামা সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে। লুকিয়ে সংগ্রহ করলেন ‘দেবদাস’-এর পাণ্ডুলিপি। শরৎচন্দ্রের অজ্ঞাতসারেই শুরু হল প্রকাশ। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায়। ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যার শুরু। ১৩২৪-এর আষাঢ়ে শেষ। অব্যবহিত পরেই ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সম্পূর্ণ ‘দেবদাস’ উপন্যাস মলাটবন্দি হয়। প্রকাশক ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’। অবিভক্ত বাংলায় পাঠক সমাজের হাতে এল ‘দেবদাস’। অবশ্য শরৎচন্দ্রের জীবনবৃত্তান্তে চমকপ্রদ তথ্য মেলে। ১৯০০ সালে শরৎচন্দ্র নাকি এই উপন্যায় লেখা শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স বছর চব্বিশ। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, তা এখনও গবেষণা-বিবেচ্য।
উপন্যাসের শতবর্ষ। কিন্তু ষোড়শ পরিচ্ছেদের কাহিনি মানব মানসে আজও যৌবনে। অমরত্ব যেন তার পরিচিতিতেই। বারবার চলচ্চিত্রে ঘটেছে ‘দেবদাস’-এর নির্মাণ-বিনির্মাণ। কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু সেই প্রেম। কৃত্বিত্ব কিন্তু অবশ্যই কথাশিল্পীর। নিখাদ আবেগ। বাস্তব চালচিত্র। সংস্কার-কুসংস্কার। আর্থিক–বর্ণ-কৌলিন্য। চরিত্র নির্মাণ। ঘটনাস্থলের বৈচিত্র্যময় নির্বাচন, যা স্রেফ শরৎচন্দ্রেরই আপন শৈলি। শুরু থেকেই ঠাস বুনন। পাঠক বাঁধা পড়ে কাহিনির শেষ তক্ পড়ার তাগিদে।
আর একে উপজীব্য করেই ‘দেবদাস’-এর চাহিদা। নির্মাণ হয়েছে যুগে যুগে অনেক চলচ্চিত্র। আগামী দিনেও যা পূর্ণচ্ছেদ পাবে না বলেই অনুমান। ‘দেবদাস’ ঘটনাবহুল। আবার ঘটনাগুলি বহুস্থানিক। তালসোনাপুর, হাতিপোতা, কলকাতা, অশত্থঝুড়ি, কাশী, এলাহাবাদ, মুম্বই-সহ নানা স্থান। কমবেশি সবই গুরুত্বপূর্ণ। তবু অনন্যমাত্রিক হাতিপোতা, যার উল্লেখ উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদে। হাতিপোতা গ্রামে জমিদার ভুবন চৌধুরীর দালান। উপন্যাসের শেষও এই গ্রামে। জমিদার বাড়ির সামনে।
হাতিপোতা গ্রাম কিন্তু কাল্পনিক নয়। বাস্তবে এই গ্রামের অবস্থান রয়েছে বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমায়। ধাত্রীগ্রামের কাছে। নান্দাই পঞ্চায়েতে। সরকারি জরিপে তা স্টেশন পান্ডুয়া থেকে ‘ষোলো ক্রোশ পথ’। অতীতে গোরুর গাড়ির একটা পথও ছিল বলে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস।
হাতিপোতা আজও দেবদাসময়। গ্রামের প্রাচীন মানুষদের বিশ্বাস, শরৎচন্দ্র নদীপথে নান্দাই এসেছিলেন এক বার। সে সময় স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। শোনেন ‘দেবদাস’-এর অনুরূপ এক জনশ্রুতি, যা কতকটা হাতিপোতা গ্রামের জমিদার চৌধুরীবাড়ি কেন্দ্রিক। তার পরে শরৎচন্দ্র তাঁর কল্পনা, স্ব-অভিজ্ঞতা ও এই লোককথিত গল্প মিশিয়ে লেখেন ‘দেবদাস’। গ্রামে রয়েছে এক ঈদ্গাহ। আর সেখানে প্রাচীন এক ইটের মহল্লার ধ্বংসাবশেষ। গ্রামবাসীরা বলেন, এটাই ছিল জমিদারদের কাছারিবাড়ি। কতিপয় বৃদ্ধদের কথায়, সেখানে একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছও ছিল। উপন্যাস অনুযায়ী, যার তলায় রোগক্লিষ্ট নায়ক দেবদাস শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ গাছটি নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে লুপ্ত।
হাতিপোতার গ্রামবাসীদের মন-মজ্জায় দেবদাস। তাঁরা সেখানে গড়েছেন ‘দেবদাস স্মৃতি ক্লাব’। মাঘের প্রথম সপ্তাহে প্রতি বছর বসে দেবদাস মেলা। দেবদাসকে তাঁরা নিজেদের মানুষ বলে মনে করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে প্রায়ই হাতিপোতায় আসেন দেবদাস অনুরাগী সংস্কৃতিবান মানুষ। অনেক কিছু জানার ইচ্ছে নিয়ে কথা বলেন। যোগাযোগ রাখেন হাতিপোতার সঙ্গে। ‘দেবদাস’-এর শতবর্ষে তাঁদেরও আগ্রহে খামতি নেই।
অনেকের কাছে ‘দেবদাস’-এর অর্থটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাণিজ্যিক আয়-উৎসের উর্বর আধার। কোটি কোটি টাকার সফল বাজি। চলচ্চিত্র জগৎ থেকে প্রকাশনা ঘর। কিন্তু শতবর্ষের কথা কার্যত তাঁদের অজানা রয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়।
শুধু মনে রেখে দেয় হাতিপোতা। মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। সম্প্রীতি আর শ্রদ্ধায়। গর্বে আর অহঙ্কারে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং তার কালজয়ী ‘দেবদাস’-কে।
লেখক স্কুলশিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy