Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শান্তিপুরে হামলায় ধৃত ২, মনোজ এখনও অধরাই

মঙ্গলবার সকাল থেকে পুলিশ বলছিল, পিস্তল-টিস্তল নিয়ে কেউ কলেজে ঢুকেছে, এমন প্রমাণ তারা পাচ্ছে না।দিনভর টানা জেরার পরে সেই পুলিশই রাতে দু’জনকে গ্রেফতার করল, এবং অস্ত্র আইনেই!

অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা। মঙ্গলবার শান্তিপুর কলেজে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা। মঙ্গলবার শান্তিপুর কলেজে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

সুস্মিত হালদার
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ০৪:২৬
Share: Save:

মঙ্গলবার সকাল থেকে পুলিশ বলছিল, পিস্তল-টিস্তল নিয়ে কেউ কলেজে ঢুকেছে, এমন প্রমাণ তারা পাচ্ছে না।

দিনভর টানা জেরার পরে সেই পুলিশই রাতে দু’জনকে গ্রেফতার করল, এবং অস্ত্র আইনেই!

দু’জনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি আরও দু’জনকে আটক করে জেরা করা হচ্ছে। যদিও ঘটনার মূল কান্ডারি বলে যাঁর দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে, শান্তিপুর কলেজের সেই প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক তথা টিএমসিপি-র শহর সভাপতি মনোজ সরকারকে ধরা দূরে থাক, থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি পুলিশ!

সোমবার দুপুরে নদিয়ার শান্তিপুর কলেজে স্টাফরুমে ঢুকে যারা অঙ্কের শিক্ষক অমরজিৎ কুণ্ডুকে মারধর করে খুনের হুমকি দিয়েছিল (পিস্তল উঁচিয়ে শাসিয়েছিল এক জন), তাদের অনেককেই পরে অধ্যক্ষের ঘরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে। ফলে অধ্যক্ষ চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য লিখিত অভিযোগে কারও নাম না দিলেও হামলাকারীদের চিহ্নিত করা পুলিশের পক্ষে খুব শক্ত ছিল না।

শিক্ষাঙ্গনে প্রায় সত্তর দশকের ধাঁচে নৈরাজ্য ফিরিয়ে আনার এই ঘটনা সোমবার প্রথমে জানতেন না বলে দাবি করেছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তবে রিপোর্ট পাওয়ার পরে এ দিন তিনি কড়া বার্তা দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘শান্তিপুর কলেজের মধ্যে যে গুন্ডামি করা হয়েছে, কোনও ভাবেই তা বরদাস্ত করা যায় না। কলেজ কর্তৃপক্ষ উচ্চ শিক্ষা দফতরের সাহায্য চেয়েছেন। যারাই ঘটনা ঘটিয়ে থাকুক, প্রশাসনিক ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফুটেজের সিডি দেখে কয়েক জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতারও করেছে।’’

শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, ওই কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ আছে। তবে তাঁর মন্তব্য, ‘‘অভিযোগ থাকলে বা আইন-আদালতের বিষয় থাকলেও কোথাও কোনও ছাত্র বা অ-ছাত্রদের অধিকার জন্মায় না শিক্ষককে এ ভাবে হেনস্থা করার!’’

মঙ্গলবার সকালেই সন্দেহভাজন চার জনকে শান্তিপুর থানায় তুলে এনে জেরা শুরু করে পুলিশ। এর মধ্যে তিন জনই মনোজের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী বলে পরিচিত। রাতে যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের অন্যতম সাহাবুদ্দিন শেখ পেশায় রাজমিস্ত্রি। জীবনে কখনও কলেজের চৌকাঠ মাড়াননি! দ্বিতীয় জন, সুদীপ বিশ্বাস কিন্তু শান্তিপুর কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। এক সময়ে ছাত্র পরিষদ করলেও পরে টিএমসিপি-তে চলে যান। তিনি চিরকালই মনোজের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত। কলেজে হামলার ঘটনায় যত জনের দিকে পুলিশের নজর, তার মধ্যে এক মাত্র সুদীপই মনোজের শাগরেদ নন। তবু কেন তিনি ওই গোলমালে গিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। দু’জনের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও খুনের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি অস্ত্র আইনেও মামলা রুজু করা হয়েছে।

সোমবার যাঁকে সিসিটিভি ফুটেজে হাত তুলে অধ্যক্ষকে শাসাতে দেখা গিয়েছিল, সেই মনোজের বাড়ি শান্তিপুর থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে, সরাগড় এলাকার দেশবন্ধু কলোনিতে। পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করল না কেন?

পুলিশের বক্তব্য, তারা সকালে মনোজের বাড়িতে গিয়েছিল, সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়নি। দেশবন্ধু কলোনিতে তাঁদের কাছাকাছি দু’টি বাড়ি। একটি পৈতৃক বাড়ি, সেখানে সস্ত্রীক মনোজ কাকাদের সঙ্গে থাকেন। রাতে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর ঘরটি তালাবন্ধ। কাকার মেয়ে মৌসুমী জানান, সোমবার রাত থেকে মনোজ বাড়িতে নেই। কাছেই একটি একতলা বাড়িতে স্ত্রী ও ছোট ছেলে, শান্তিপুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মণিকে নিয়ে থাকেন মনোজের বাবা (স্থানীয় ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর) মাধব সরকার। রাতে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মাধববাবু ঘরে বসে টিভি দেখছেন, বাইরে বারান্দায় বসে মনোজের মা দুর্গারানি। তাঁদের দাবি, মনোজ সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ এসে মোটরবাইক নিয়ে চলে যায়। আর তার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হয়নি।

সারা দিনে বেশ কয়েক বার মনোজের মোবাইলে ফোন করা হলেও তা বন্ধ ছিল। রাতে ফোন ধরে তিনি দাবি করেন, ‘‘আমি কাল ছাত্রস্বার্থে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। সেটাই উনি অন্য ভাবে ব্যবহার করছেন। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।’’ তা হলে আপনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? মনোজের ব্যাখ্যা, ‘‘একটা তদন্ত শুরু হয়েছে। তাই আমি শান্তিপুর ছেড়ে চলে গিয়েছি।’’ আপনার ঘনিষ্ঠ সাহাবুদ্দিন শেখকে তো পুলিশ গ্রেফতার করেছে? মনোজ বলে ওঠেন, ‘‘ওকে তো সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়নি!’’ যে দু’জনকে আটক করা হয়েছে সেই ছোটু শেখ ও নিতাই দাস তো বটেই, এমনকী সন্দেহভাজনের তালিকায় যে সব নাম রয়েছে তারা প্রায় সকলেই মনোজের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। এদের নাম উঠছে কেন? সতর্ক গলায় মনোজ বলেন, ‘‘দেখা যাক, তদন্ত তো চলছে। সাহাবুদ্দিন কিন্তু আমার ঘনিষ্ঠ নয়।’’

এ দিন কলেজ ছিল থমথমে। ক্লাসে হাজিরাও খুব কম। কংগ্রেস বিধায়ক অরিন্দম ভট্টাচার্যের নেতৃত্ব শহরে নাগরিক মিছিল বেরোয়। যা নিয়ে এত গণ্ডগোল, সেই কলেজের পরিচালন সমিতির শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন স্থগিত হয়ে গিয়েছে। আজ, বুধবার ওই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। শাসকদলের হুমকি অগ্রাহ্য করে অমরজিৎ কুণ্ডু-সহ কিছু শিক্ষক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, এই আশঙ্কায় তাঁদের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ। অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

santipur college accuse police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE