সৌমেন দেবনাথ
দু’দিন আগেই মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় হেলমেট-বিহীন মোটরবাইক চালকদের হাতে ফুল দিয়ে, জয়নগরের মোয়া খাইয়ে গাঁধীগিরি করেছিল পুলিশ। শনিবার সেখানেই হেলমেট না পরায় সিভিক ভলান্টিয়ারের হাতে মার খেয়ে এক স্কুটি-চালকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠল।
ওই ঘটনার জেরে এ দিন সকাল থেকে দফায় দফায় অবরোধ ও থানা ঘেরাওয়ে উত্তপ্ত হল মধ্যমগ্রাম। নামল বিশাল পুলিশ বাহিনী, র্যাফ। ঘটনাস্থলে গিয়ে হেনস্থা হলেন জনপ্রতিনিধিরা। অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ারকে পরে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অনভিপ্রেত ঘটনা। অভিযোগের ভিত্তিতে ওই কর্মীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হয়েছে।’’
শনিবার বেলা ১১টা নাগাদ মধ্যমগ্রামের শ্রীনগর শিবতলার বাড়ি থেকে মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় ব্যবসার কাজে আসছিলেন সৌমেন দেবনাথ (৫০)। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সৌমেনবাবু হেলমেট পরেননি। সেটি স্কুটিতে ঝোলানো ছিল। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের কাছে তাঁকে আটকান সৌমেন রায় নামের এক সিভিক ভলান্টিয়ার। হেলমেট পরা নিয়ে দুই সৌমেনের মধ্যে প্রথমে কথা কাটাকাটি, পরে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। অভিযোগ, সেই সময়ে স্কুটি-আরোহী সৌমেনবাবুর কানে চড় মারেন সিভিক ভলান্টিয়ার সৌমেন। আঘাত করেন কাঁধেও। মাটিতে পড়ে যান সৌমেনবাবু। অন্য সিভিক ভলান্টিয়ার ও পথচারীরা ছুটে আসেন। তাঁরাই সৌমেনবাবুকে তুলে পাশের মধ্যমগ্রাম মাতৃসদন হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আগেই মৃত্যু হয়েছে সৌমেনবাবুর।
আরও পড়ুন: নিজেদের পুলিশ ভেবে দেদার দাপট
এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের উপরে জনতার ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। গাড়ি পরীক্ষার নামে তাঁরা সাধারণ মানুষকে অত্যাচার করছেন বলে অভিযোগ তুলে মধ্যমগ্রাম চৌমাথায় ট্রাফিক পুলিশ বুথে চড়াও হন গাড়িচালক, দোকানি, পথচারী ও স্থানীয়রা। ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে একটি সুলভ শৌচাগারে আশ্রয় নেন সৌমেন ও অন্য সিভিক ভলান্টিয়ারেরা। দরজা ভেঙে তাঁদের বার করার চেষ্টা চালায় জনতা। আসে মধ্যমগ্রাম থানার পুলিশ। সৌমেন তখন ওই শৌচাগারের পাশে একটি পাকা নর্দমার মধ্যে আশ্রয় নেন। তাঁকে লক্ষ করে ইট ছুড়তে থাকে জনতা। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। কোনও মতে তাঁদের উদ্ধার করে মধ্যমগ্রাম থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।
এ বার থানা ঘেরাও করে শুরু হয় বিক্ষোভ। জনতা দাবি তোলে, ওই সিভিক ভলান্টিয়ারদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। অবরোধ হয় মধ্যমগ্রাম চৌমাথা। ফলে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে কলকাতার সঙ্গে বারাসত, বসিরহাট, বনগাঁ এবং উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে আশপাশের সমস্ত থানার পুলিশ ও র্যাফ পথে নামে। কিন্তু হাজার জনতাকে সামলাতে নাজেহাল হয় সেই বাহিনীও।
পিতৃহারা: মধ্যমগ্রামে সিভিক ভলান্টিয়ারের মারে প্রাণ হারানো সৌমেন দেবনাথের দুই মেয়ে। —নিজস্ব চিত্র।
মধ্যমগ্রাম পুরসভার চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক রথীন ঘোষ, বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সনৎ বিশ্বাসেরা ঘটনাস্থলে আসেন। ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পান সনৎবাবু। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েক দফায় চলে অবরোধ-ঘেরাও। বিকেলের পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়। বারাসত হাসপাতালে ময়না-তদন্তের পরে সৌমেনবাবুর দেহ বাড়িতে পাঠায় পুলিশ।
ব্লাউজ আর ইট কেনাবেচার ব্যবসা করে সংসার চালাতেন সৌমেনবাবু। একমাত্র ছেলের এমন মৃত্যুতে তাঁর বৃদ্ধ বাবা সুধীরবাবু, মা শেফালিদেবী কথা হারিয়েছেন। প্রতিবেশীদের কোলে দুই মেয়ে, মেঘা ও স্নেহা কেঁদেই চলেছে। মাঝেমধ্যেই জ্ঞান হারাচ্ছেন স্ত্রী কাকলিদেবী। কোনও মতে বললেন, ‘‘এই সামনে যাবে বলে হেলমেটটা নিয়েই তো বেরোল। একটা হেলমেটের জন্য পিটিয়ে মেরে দিল। আমার সংসারটার কথা এক বারও ভাবল না?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy