Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রশিক্ষণে পরিষেবায় উন্নতি হাতুড়েদের, দাবি গবেষণায়

পাশ না-করা পল্লি চিকিৎসক (চলতি কথায় হাতুড়ে ডাক্তার) খলনায়ক, না উপেক্ষিত নায়ক— তা নিয়ে মতামত বহু শোনা গিয়েছে। এ বার মিলল তথ্য। জানা গেল, প্রশিক্ষণ পেলে ডিগ্রিহীন ডাক্তারেরাও স্বাস্থ্য-পরিষেবা দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন।

স্বাতী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

পাশ না-করা পল্লি চিকিৎসক (চলতি কথায় হাতুড়ে ডাক্তার) খলনায়ক, না উপেক্ষিত নায়ক— তা নিয়ে মতামত বহু শোনা গিয়েছে। এ বার মিলল তথ্য। জানা গেল, প্রশিক্ষণ পেলে ডিগ্রিহীন ডাক্তারেরাও স্বাস্থ্য-পরিষেবা দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন। যাঁরা নিয়মিত ক্লাস করে কোর্স শেষ করেছেন, তাঁদের চিকিৎসার মান সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেলা পরিষেবার খানিকটা কাছাকাছি যেতে পেরেছে।

বৃহস্পতিবার ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি চিকিৎসা-নীতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা উস্কে দিল। সেটি লিখেছেন বিশ্বব্যাঙ্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের ‘লিভার ফাউন্ডেশন’-এর গবেষকেরা। তথ্য সংগৃহীত হয়েছে বীরভূম জেলা থেকে।

‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-সহ অধিকাংশ চিকিৎসক সংগঠন ডিগ্রিহীন ডাক্তারদের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে, হাতুড়েদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় স্থান দেওয়া অনৈতিক ও ক্ষতিকর। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর জানাচ্ছে, এ রাজ্যের ৩৮ হাজার গ্রামে হাতুড়ে ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ। আর রাজ্যে নথিভুক্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ৪০ হাজারের কিছু বেশি। এই ৪০ হাজারের ৮০ শতাংশ কাজ করেন শহরের হাসপাতালগুলিতে। অর্থাৎ, গ্রামের জন্য বরাদ্দ বড়জোর আট হাজার চিকিৎসক।

পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার চাবিকাঠিটা কাদের হাতে। সেখান থেকেই এসেছে যুক্তি, গ্রামীণ ভারতে ৭৫ শতাংশ মানুষ যান ‘হাতুড়ে’-র কাছে। রাষ্ট্র এঁদের দূরে ঠেললে তাতে জনস্বাস্থ্যেরই ক্ষতি নয় কি? এই বিতর্কের উত্তর যে মেলেনি, তার কারণ হাতুড়েদের প্রশিক্ষণ দিলে সুফল মেলে কি না সে বিষয়ে তথ্য ছিল না। সে বিষয়ে হাতেকলমে পরীক্ষা এই প্রথম।

এই গবেষণার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল চারটি ব্লকের ৩০৪ জন পল্লি চিকিৎসককে। তাঁদের ১৫২ জন ‘লিভার ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে ন’মাসে ৭২টি ক্লাস করেন। বাকি ১৫২ জন প্রশিক্ষণ নেননি। দুই দলের ফারাক পরীক্ষা করতে কয়েকটি লোককে শিখিয়ে-পড়িয়ে ‘রোগী’ সাজানো হয়। তাঁরা চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে কয়েকটি রোগ-লক্ষণ (বুকে ব্যথা বা পেট খারাপ বা শ্বাসকষ্ট) বলেন। সে সব লক্ষণ দেখা গেলে যে-যে প্রশ্ন ও পরীক্ষা করার কথা, যে পরামর্শ দেওয়ার কথা, চিকিৎসক তা করছেন কি না, তা ডায়েরিতে নোট করেন ‘রোগী’। এগারো জন সরকারি ডাক্তারের কাছেও ‘রোগী’রা যান।

ওই সব ডায়েরি পড়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা নির্ধারণ করেন, চিকিৎসার মান কেমন হয়েছে। যদিও কে প্রশিক্ষণ পেয়েছে, কে পায়নি, কে সরকারি ডাক্তার— তাঁরা জানতেন না। যেমন চিকিৎসকেরা জানতেন না, কোনও চিকিৎসাপ্রার্থী আসল রোগী নয়। যাঁরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তাঁরাও জানতেন না ‘রোগী’ কোন রোগ-লক্ষণ নিয়ে তাঁদের ‘ছাত্র’দের কাছে যাবে।

এই পদ্ধতিতে (‘র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল’) নিরীক্ষার ফল কী বলছে? বলছে, রোগ নির্ণয় এবং ঠিক চিকিৎসা-পরামর্শ দেওয়ার ব্যাপারে প্রশিক্ষণহীন ডাক্তারদের চাইতে অনেক এগিয়ে সরকারি ডাক্তারেরা। কিন্তু প্রশিক্ষণ এগনোর সঙ্গে সঙ্গে পল্লি চিকিৎসকদের মধ্যে রোগী সংক্রান্ত জরুরি তথ্য সংগ্রহ বা রোগ নিরাময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করায় সচেতনতা বাড়তে দেখা গিয়েছে। তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পল্লি চিকিৎসকেরাও অনেক ক্ষেত্রে অদরকারি ওষুধ লিখেছেন। গবেষণার ফলে সন্তুষ্ট গবেষক-চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘অনেকে বলেন, চোরকে চুরি করতে শেখানোর মতো, পল্লি চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিলে তাঁরা ক্ষতি করবেন রোগীদের। দেখা গেল, সে আশঙ্কা ভুল।’’

তা হলে কি রোগীকে প্রাথমিক পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এমবিবিএসের সঙ্গে পাশ না-করা পল্লি চিকিৎসকের তফাত কমছে? এই গবেষণার সহ-লেখক এমআইটি-র অর্থনীতির শিক্ষক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি ডাক্তারদের জ্ঞান ও দক্ষতা অনেক বেশি। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতালে কাজের সময়ে ডাক্তারদের একাংশ সেগুলো প্রয়োগ করেন না।’’ একে ডাক্তারদের অনেকে গ্রামে কাজ করায় অনিচ্ছুক, তায় অনেকে গ্রামে বদলি হলে শহরে ‘প্র্যাক্টিস’ করেন, মাঝেসাঝে গ্রামে যান। এই পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষিত পল্লি চিকিৎসকেরা রোগীদের অন্তত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাটুকু দিতে পারবেন বলে আশাবাদী গবেষকেরা।

ঘটনা হল, গ্রামে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানোয় ব্যর্থ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর দু’লক্ষ পল্লি চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গত নভেম্বরে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জানিয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্তের কথা। কিন্তু তার পরে এত দিন কাটলেও সরকারি ভাবে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি। হাতুড়ে ডাক্তারদের সংগঠন ‘পল্লি চিকিৎসক সংযুক্ত সংগ্রাম কমিটি’র ধারণা, প্রশিক্ষণের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ছবিটা বদলাতে পারত।

তবে পল্লি চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য পরিষেবায় কাজে লাগানো নিয়ে রাজ্য সরকার যে নীতিই নিক, স্বাস্থ্য দফতর যে ভাবে স্বাস্থ্য-নীতি নিয়ে গবেষণাকে সমর্থন করেছে এবং তার ফলাফলকে গ্রহণ করেছে— তাতে খুশি গবেষকেরা। ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং অন্য রাজ্য সরকারের সব দফতর যেন নীতি নিয়ে পরীক্ষার প্রতি এমন খোলা মন রেখে চলে,’’ মন্তব্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Quackers medical training
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE