‘ক্ষতিপূরণ মিলবে’ জানিয়ে সরকারি চিঠিটা তাঁর বাড়িতে এসেছিল গত বুধবার দুপুরে। তখনও এসএসকেএম হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন ঘাটালের অ্যাসিড আক্রান্ত বিধবা মহিলা। তবে, ক্ষতিপূরণের টাকাটা আর হাতে পাওয়া হল না তাঁর। শনিবার দুপুরে কলকাতার ওই হাসপাতালেই থেমে গেল বছর তিরিশের ওই মহিলার গত দেড় মাসের জীবন-মরণ লড়াই।
এই নিয়ে গত দু’বছরে এ রাজ্যে তিন জন অ্যাসিড আক্রান্তের মৃত্যু হল। আগের দু’টি ক্ষেত্রে আক্রান্তের পরিবার ক্ষতিপূরণই পায়নি। আর ঘাটালের আক্রান্ত মহিলার পরিজনেরা পেলেন শুধু ক্ষতিপূরণের আশ্বাস। শনিবার তাঁর মৃত্যুর পরে শোকার্ত শাশুড়ির ক্ষোভ, ‘‘টাকাটা আগে পেলে বৌমার চিকিৎসা আরও ভাল করে করা যেত। টাকাটা ওর কাজে লাগল কই?’’
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, কেউ অ্যাসিড-হামলার শিকার হলেই প্রাথমিক ভাবে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু যথাসময়ে ক্ষতিপূরণ না মেলার অভিযোগও উঠেছে ভূরি ভূরি। শুক্রবারই এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে রাজ্যে ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে, সেখানে অ্যাসিড-আক্রান্তদের চিকিৎসার খরচ ও তাঁদের পুনর্বাসনে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার! এর মধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের ওই মহিলার মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নির্দেশ আর তার রূপায়ণে ফাঁকটা সত্যিই বিস্তর। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ক্ষতিপূরণ পাননি রাজ্যে গত দু’বছরে মৃত আরও দুই অ্যাসিড আক্রান্তও।
মারণ অ্যাসিড
সাল আক্রান্ত
• ২০১১ ১৩
• ২০১২ ২২
• ২০১৩ ৮
• ২০১৪ ৪১
• ২০১৫ ৪১
• ২০১৬ ২৬
(গত পাঁচ বছরে এ রাজ্যে অ্যাসিড আক্রান্তের খতিয়ান। সূত্র: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো)
* গত দু’বছরে অ্যাসিড আক্রান্ত তিন মহিলার (ঘাটালের এই মহিলা-সহ) মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
ঘাটালের মৃত মহিলার পরিবারের ক্ষোভও ঠিক সেখানেই। তাঁর দাদা একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘‘বোনের চিকিৎসার জন্য ধারও করতে চেয়েছে। আমাদের মতো গরিব মানুষদের কাছে এ ক্ষেত্রে সরকারি টাকাটা খুব দরকারি।’’ ঘাটালের মহকুমাশাসক পিনাকিরঞ্জন প্রধানের অবশ্য দাবি, ‘‘মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর পেতে সমস্যা হচ্ছিল। তাই চিঠি পৌঁছতে সময় লাগল।’’
চলতি বছরের প্রথম রাতে ওই মহিলাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মাথায় অ্যাসিড ঢেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে গ্রামেরই যুবক মন্টু দোলইয়ের বিরুদ্ধে। অ্যাসিডে ঝলসে মহিলার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে যায়। নাক, মুখ গলে গিয়েছিল। চিবুক আর গলা একসঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় মুখ মাংসপিণ্ডের মতো হয়ে গিয়েছিল। খেতে পর্যন্ত পারতেন না তিনি। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের টানাপড়েনেই এই হামলা বলে তদন্তে জেনেছিল পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছিল মন্টুকে। সে ছিল সোনার কারিগর। ফলে, অ্যাসিড হাতের নাগালেই ছিল। আপাতত ঘাটাল উপ-সংশোধনাগারে রয়েছে মন্টু। পুলিশ জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে চার্জশিট আগেই জমা পড়েছে। এ বার খুনের মামলা যুক্ত করা হবে।
আরও পড়ুন: স্বেচ্ছামৃত্যু নয়, জীবনে ফেরার স্বপ্নে বুঁদ যুবক
এই মৃত্যু ফের উস্কেছে রাজ্যে বেড়ে চলা অ্যাসিড-হামলা ও ভয়াবহ পরিণতি ঘিরে চর্চা। গত দু’বছরে অ্যাসিড হামলায় মৃত্যু হয়েছে তারকেশ্বর ও উত্তর ২৪ পরগনার আরও দুই মহিলার। দু’টি ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ধরা পড়লেও মামলা মেটেনি। রাজ্যের মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘প্রতি ক্ষেত্রেই প্রতিহিংসা অ্যাসিড হামলার কারণ। আমি যাকে পাব না, আর কাউকে পেতে দেব না, এই মানসিকতা থেকেই মণ্টুর মতো লোকেরা অ্যাসিডকে হাতিয়ার করছে।’’ শনিবার সকালে মায়ের মৃত্যুর খবর শোনা থেকে কেঁদেই চলেছে মহিলার বছর পনেরোর ছেলে। কান্নার মাঝেই সে বলে, ‘‘আমার মাকে যে অ্যাসিড দিয়ে মারল, তার চরম শাস্তি চাই। আমি পড়ব। সঙ্গে শাস্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।’’ মেয়ের মৃত্যুর খবরে চোখের জল বাঁধ মানছে না মহিলার মায়েরও। তিনি বলেন, ‘‘মাংসপিণ্ড হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। এ ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে ওর মৃত্যুই ভাল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy