Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নিজেদের পুলিশ ভেবে দেদার দাপট

আইন রক্ষার স্বার্থে স্থানীয় থানা থেকে ‘সিভিপি’ লেখা টি-শার্ট দেওয়া হয় তাঁদের। প্যান্ট, জুতো-চটি নিজেদের। ২০১৩-র মার্চে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এ রকম ১ লক্ষ ৩০ হাজার সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করেছিল রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর।

আত্মগোপন: তাড়া খেয়ে এলাকার একটি বাড়ির কার্নিসে এক সিভিক পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

আত্মগোপন: তাড়া খেয়ে এলাকার একটি বাড়ির কার্নিসে এক সিভিক পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০৩:৩৭
Share: Save:

যানজট সামলানো কিংবা দৈনন্দিন আইন-শৃঙ্খলার কাজে পুলিশকে সাহায্য করার উদ্দেশেই ওঁদের নিয়োগ। কিন্তু উর্দিধারীদের একাংশের আড়ালে থেকে বহু ক্ষেত্রে ওঁরাই হয়ে উঠেছেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। অভিযোগ অজস্র। রাস্তায় মোটরবাইক আরোহীকে দাঁড় করিয়ে নথিপত্র দেখতে চাওয়া থেকে নির্মীয়মাণ বহুতলের কাজ বন্ধের হুমকি দেওয়া, মায় লরি আটকে তোলা আদায়— আকাশি গেঞ্জি গায়ে ও চটি পায়ে দেওয়া কিছু লোকের এ সব কাজ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে রাজ্যবাসী। ওঁরা পাড়ার ‘বেকার’ ছেলে, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ, পোশাকি নাম ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’, সংক্ষেপে ‘সিভিপি’।

আইন রক্ষার স্বার্থে স্থানীয় থানা থেকে ‘সিভিপি’ লেখা টি-শার্ট দেওয়া হয় তাঁদের। প্যান্ট, জুতো-চটি নিজেদের। ২০১৩-র মার্চে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এ রকম ১ লক্ষ ৩০ হাজার সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করেছিল রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতর। তাতে বলা হয়েছিল, রোজ ১৪১ টাকা ৮৫ পয়সা দেওয়া হবে। কাজ না করলে সে দিনের মজুরি কাটা যাবে। কাজ শুরুর আগে ১০ দিনের প্রশিক্ষণ হবে। মূলত, যানশাসন, উৎসব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে, তার চেয়েও বেশি নিজেদের কাজ হালকা করতে সারা বছরই বিভিন্ন কাজে ভলান্টিয়ারদের ব্যবহার করে থানাগুলি। ফলে নিজেদেরও পুলিশ ভাবে ভলান্টিয়ারদের একাংশ।

পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গোড়ায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে এঁদের বহাল করা হয়েছে। পরবর্তী কালে প্রশাসনের কর্তাদের কেউ কেউ তাঁদের দেহরক্ষী কিংবা বাড়ির কাজের লোকের আত্মীয়কে এই কাজে ঢুকিয়েছেন। হাওড়ার একটি থানার ওসি বলছিলেন, ‘‘সুপারিশের চাপ এতটাই যে, কোটা ছাড়িয়ে সিভিক ভলান্টিয়ার নিতে বাধ্য হয়েছি। চেয়েচিন্তে তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে হয়।’’ পুলি‌শের একাংশের প্রশ্রয়ে ওই ভলান্টিয়ারদের অনেকে যে মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে, মানছেন ওই ওসি।

আগে রাস্তাঘাটে হামেশাই দেখা যেত, কিছু ট্রাফিক কনস্টেবল গাড়ি থামিয়ে পয়সা নিচ্ছেন। এখন সেই ছবি অনেকটাই ফিকে। কারণ? সূত্র জানাচ্ছে, পুলিশের একাংশ এখন সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে ওই কাজটা করান। শনিবার যেখানে সিভিক ভলান্টিয়ারের মারে এক ব্যক্তির মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে সেই মধ্যমগ্রামের মানুষ জানাচ্ছেন, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে নানা মোড়ে কিছু সিভিক ভলান্টিয়ার গাড়ি থামিয়ে চরম হেনস্থা করেন। থানার অফিসার সঙ্গে‌ না থাকলে গাড়ি থামানোর এক্তিয়ারই নেই তাঁদের। কিন্তু কোনও কিছু তোয়াক্কা না করে সিভিক ভলান্টিয়ারেরাই ট্রাফিক পুলিশের একাংশের সই ও সিলমোহর দেওয়া ‘ফাইন বুক’ নিয়ে জরিমানা করে দিচ্ছেন।

সিভিক ভলান্টিয়ারের ‘মাতব্বরি’র উদাহরণ রয়েছে হুগলির চণ্ডীতলাতেও। গত ৯ সেপ্টেম্বর চণ্ডীতলার গঙ্গাধরপুরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন ভাই-বোন। তাঁদের প্রেমিক-প্রেমিকা ভেবে আপত্তিকর আচরণের অভিযোগ তুলে এক সিভিক ভলান্টিয়ার চড় মারেন বলে অভিযোগ। হুগলির এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘আমাদের কোনও কর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বা পুলিশ লাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সিভিক ভলান্টিয়ারেরা বুঝে গিয়েছেন, ওঁদের তেমন শাস্তি দেওয়ার উপায় নেই। ফলে পুলিশের নাম ভাঙিয়ে মর্জিমতো কাজ করে চলেছেন।’’ পশ্চিমবঙ্গ সিভিক ভলান্টিয়ার সংগঠনের এক নেতা বলেন, ‘‘এই চাকরির কোনও নিয়ম-নীতি নেই। নিয়োগপত্রও নেই। কিছু না থাকার কারণেই যে যা খুশি করছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE