Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

বিরোধী-প্রচারেও বাধা, কাঠগড়ায় শাসক দল

চিত্র ১: হরিণঘাটা। আসন্ন পুরভোটে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন তিনি। সেই প্রার্থী বলছিলেন, ‘‘রাস্তায় আমার সামনে আচমকা মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এলাকার কিছু সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। এ কথা-সে কথার পরে পরামর্শ দেওয়ার ঢঙে বলল, ‘ভোটে দাঁড়িয়েছ, ভাল কথা। কিন্তু অহেতুক প্রচারে বেরোনোর দরকার নেই। বুঝতেই পারছ, সময় ভাল নয়।’ এমন ঠান্ডা ভাবে বলল কথাগুলো, যে এলাকায় প্রচার চালানো তো দূর, বাড়িতে থাকারই সাহস পাচ্ছি না।’’ ভয়ে নাম প্রকাশেও তিনি অনিচ্ছুক।

হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় সম্প্রতি এক সিপিএম প্রার্থীর বাড়িতে ভাঙচুরের পর। — ফাইল চিত্র

হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় সম্প্রতি এক সিপিএম প্রার্থীর বাড়িতে ভাঙচুরের পর। — ফাইল চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫৫
Share: Save:

চিত্র ১: হরিণঘাটা। আসন্ন পুরভোটে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন তিনি। সেই প্রার্থী বলছিলেন, ‘‘রাস্তায় আমার সামনে আচমকা মোটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল এলাকার কিছু সক্রিয় তৃণমূল কর্মী। এ কথা-সে কথার পরে পরামর্শ দেওয়ার ঢঙে বলল, ‘ভোটে দাঁড়িয়েছ, ভাল কথা। কিন্তু অহেতুক প্রচারে বেরোনোর দরকার নেই। বুঝতেই পারছ, সময় ভাল নয়।’ এমন ঠান্ডা ভাবে বলল কথাগুলো, যে এলাকায় প্রচার চালানো তো দূর, বাড়িতে থাকারই সাহস পাচ্ছি না।’’ ভয়ে নাম প্রকাশেও তিনি অনিচ্ছুক।

চিত্র ২: খাস কলকাতা পুরসভার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী ঝুমা দাসের দাবি, প্রচারের সময় শাসক দলের কিছু সমর্থক নানা ভাবে বাধা দিচ্ছিল তাঁদের। তাই প্রমীলা বাহিনী গড়ে সিআইটি রোড, ফুলবাগান, বেলেঘাটা মেন রোডে প্রচার করছিলেন। মহিলাদের উপরে আঁচ আসবে না, ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের গুন্ডারা মহিলাদেরও রেয়াত করছে না। সদস্যাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারে না বেরোনোর জন্য শাসাচ্ছে।’’

নদিয়া থেকে কলকাতা— অভিযোগ এক। অভিযোগের লক্ষ্যও এক। দু’জেলার তিনটি পুরসভায় কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতা দখল করা হয়ে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। তার পরেও রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় সন্ত্রাসের আবহ তৈরির অভিযোগ বন্ধ হচ্ছে না রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে। কখনও বিরোধীদের ভোট-প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ, কখনও প্রার্থী পদ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে প্রচারপর্বে দলীয় প্রার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভোটের ১০ দিন আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুললেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে বুধবার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে সূর্যকান্ত মিশ্রও বললেন, ‘‘তৃণমূল যদি ভেবে থাকে ভয় দেখিয়ে জিতবে, তা হলে মূর্খের স্বর্গে বাস করছে।’’ তবে বিরোধীদের সব অভিযোগ খারিজ করে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘সাংগঠনিক দুর্বলতা ঢাকতে আমাদের দোষী ঠাওরানোর চেষ্টা করছেন বিরোধীরা। তৃণমূল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট-প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করে।’’

ভোট-পর্বে ক্ষমতাসীনের পেশিশক্তি ব্যবহারের অভিযোগ অবশ্য এ রাজ্যে নতুন নয়। রাজ্যে পালাবদলের পর শুধু অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের ভূমিকা অদলবদল হয়েছে। যে তিনটি পুরসভায় (নদিয়ার গয়েশপুর, হুগলির তারকেশ্বর ও আরামবাগ) তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত, সেগুলিতে স্রেফ ভয় দেখিয়েই তারা কাজ হাসিল করেছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ।

কী রকম?

গত ২৭ মার্চ গয়েশপুরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি মনোনীত প্রার্থী পম্পা চট্টোপাধ্যায় আচমকা তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। ২৮ মার্চ, শনিবার ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। পম্পাদেবীর অভিযোগ, আগের দিন সকালে তাঁর আড়াই বছরের শিশুপুত্রের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে শাসক দলের আশ্রিত কয়েক জন দুষ্কৃতী হুমকি দেয়— ‘ভোটে দাঁড়ালে বিপদ হবে!’ তাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন তিনি। পম্পাদেবীর মতো বিজেপির আর এক প্রার্থীও ওই দিনে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। এবং তার পরের দিন গয়েশপুর পুরসভায় বাম, বিজেপি এবং কংগ্রেস প্রার্থীরা প্রায় সকলেই একযোগে মনোনয়ন তুলে নেন।

তারকেশ্বর এবং আরামবাগে নাম কা ওয়াস্তে কয়েকটি ওয়ার্ডে লড়ছেন বিরোধীরা। কিন্তু ওই দুই পুরসভায় তৃণমূলই ক্ষমতায় থাকছে। তৃণমূলের সন্ত্রাসেই ওই পরিস্থিতি হয়েছে, এই অভিযোগ ছিল বিজেপি ও বামেদের। এখন পুরভোটের দিন (২৫ এপ্রিল) যতই কাছে আসছে, বিরোধীরা ততই সরব হচ্ছেন উত্তর থেকে দক্ষিণের বিভিন্ন জেলায়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, সন্ত্রাসের সব অভিযোগ যেমন
অগ্রাহ্য করা যায় না, তেমনই বিরোধীদের সাংগঠনিক দুবর্লতা নিয়ে শাসক দলের কটাক্ষও পুরোপুরি কষ্টকল্পিত নয়।

যে জেলার গয়েশপুর পুরসভায় বিরোধীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার নিয়ে এত হইচই, সেই নদিয়ার অন্যত্রও ‘নীরব সন্ত্রাস’ চালানোয় অভিযুক্ত তৃণমূল। বিজেপির দাবি, প্রথম বার ভোট হতে চলা হরিণঘাটা পুরসভায় তাঁদের পাঁচ প্রার্থী এবং কল্যাণী পুর এলাকায় তিন প্রার্থী শাসক দলের হুমকির মুখে পড়ে এলাকাছাড়া। এঁদেরই অন্যতম নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই প্রার্থী, যিনি বলেছিলেন ‘সময়টা ভাল নয়’ বলে তাঁকে শাসিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের নদিয়া জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত অবশ্য বলছেন, ‘‘টিকিট পাওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়তে ব্যস্ত বিজেপি। ওদের হুমকি দিতে হবে কেন?’’

দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর পুরসভার ১৮টি আসনের মধ্যে দু’টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইতিমধ্যেই তৃণমূল প্রার্থীরা জিতে গিয়েছেন (তৃণমূলের জেলা সভাপতি বিপ্লব মিত্রের ভাই প্রশান্ত মিত্র-সহ)। বাকি আসনের বেশির ভাগে তাঁদের প্রার্থীরা প্রচার করতে পারছেন না বলে অভিযোগ সিপিএমের জেলা সম্পাদক নারায়ণ বিশ্বাসের। তাঁর কথায়,‘‘প্রার্থীরা বাড়ি থেকে বেরোলেই শাসক দল ভয় দেখাচ্ছে। কর্মী-সমর্থকেরা ভয় পাচ্ছেন। বোঝালেও তাঁদের আতঙ্ক কাটছে না।’’

অভিযোগের ধরন প্রায় এক কোচবিহারেও। জেলা সিপিএমের দাবি, তুফানগঞ্জ পুরসভার ১০ এবং ১১ নম্বর ওয়ার্ডে এবং বিজেপি-র অভিযোগ, ১০ এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচার করতে গেলে তাদের প্রার্থীদের হুমকি দেয় শাসক দল। কংগ্রেসের অভিযোগ, তৃণমূলের চাপে তাঁদের এক প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য হন। দক্ষিণ দিনাজপুরে বিপ্লব মিত্রের মতো কোচবিহারেও জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বিরোধীদের অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, ‘‘বিরোধীরা প্রচারে বেরিয়ে সাড়া পাচ্ছেন না। হতাশ হয়ে কিছু ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন।’’

পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমার পাঁচটি পুরসভায় নির্বাচন। সব ক’টিতেই কম-বেশি বিরোধীদের প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বর্ধমানের মেমারি, কাটোয়া এবং কালনা পুর-এলাকাতেও। প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে নম্বরহীন মোটরবাইকে চেপে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কিছু সমাজবিরোধী এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ও তাদের প্রার্থী-কর্মীদের হুমকি দিচ্ছে অভিযোগে মঙ্গলবারই কাটোয়ায় এক দিনের অনশন কমর্সূচি পালন করেছে কংগ্রেস। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের বর্ধমান জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘‘এ সব কাজ আমরা করেছি, আগে তা কেউ প্রমাণ করুক।’’

বহিরাগতদের এলাকায় ঢুকিয়ে বিরোধীদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বীরভূমেও। যদিও জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি চন্দ্রনাথ সিংহ বলছেন, ‘‘সংগঠন নেই, প্রার্থী পাচ্ছেন না। বিরোধীদের তো এমন বলতেই হবে।’’

কলকাতা পুরসভার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী ঝুমা দাস যেমন তাঁর প্রমীলা বাহিনীর সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসানোর অভিযোগ করেছেন। এ নিয়ে বেলেঘাটা থানায় অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি. যা শুনে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক পরেশ পাল বলেন, ‘‘এক সময় কলকাতার পুরভোট সিপিএমের গুন্ডাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে এ রকম কিছু হয় না।’’

উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া, হালিশহর, খড়দহে পেশিশক্তির জোরে বিরোধী-প্রচারে বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। হুগলির বিজেপি নেতা ভাস্কর ভট্টাচার্য তৃণমূলের বিরুদ্ধে গোটা জেলায় সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ করে চিঠি পাঠিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে।

এই অবস্থায় কলকাতা এবং রাজ্যের অন্য পুরসভার ভোট কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে করানোর দাবিতে আজ, বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার কথা বিজেপি-র এক প্রতিনিধি দলের। রাহুল সিংহের কথায়, ‘‘প্রত্যেক বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিতে হবে। তাতে যদি কয়েক দফায় ভোট নিতে হয়, কমিশনকে তা-ই করতে হবে।’’

সূর্যকান্তবাবু অবশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ রুখতে পুলিশ-প্রশাসন বা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপরে ভরসা রাখছেন না তাঁরা। বলেছেন, ‘‘আক্রমণ হলে গণ-প্রতিরোধ হবে। তখন কিছু ঘটলে, তার দায়িত্ব বর্তাবে রাজ্য
সরকারের উপরে।’’

সূর্যকান্তর ‘গণ প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার ডাককে কটাক্ষ করে তৃণমূলের মহাসচিবের মন্তব্য, ‘‘সূর্যবাবু তো নতুন বোতলে পুরনো ওষুধ। দলের নতুন রাজ্য সম্পাদক হয়ে উনি দলীয় কর্মীদের কথার টনিক দিয়ে শক্তিশালী করতে চাইছেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘নির্বাচনে প্রতিরোধ করার কী দরকার? এ তো যুদ্ধ নয়!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE