Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বাংলায় বিরল অন্নপূর্ণার মন্দির

অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রভাবে বাংলায় প্রসার ঘটেছিল অন্নপূর্ণা পুজোর। জনশ্রুতি, নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন। পরবর্তী কালে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় অন্নপূর্ণা পুজো। তবে, বাংলায় অন্নপূর্ণার মন্দির বিরল। কলকাতার কাছেই ব্যারাকপুরের তালপুকুর অঞ্চলে রয়েছে একটি অন্নপূর্ণা মন্দির, যা দেখতে অবিকল দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতো। মন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে এক কাহিনি। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য।

অন্নপূর্ণা মন্দির

অন্নপূর্ণা মন্দির

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ২৩:৩০
Share: Save:

অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রভাবে বাংলায় প্রসার ঘটেছিল অন্নপূর্ণা পুজোর। জনশ্রুতি, নদিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন। পরবর্তী কালে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় অন্নপূর্ণা পুজো। তবে, বাংলায় অন্নপূর্ণার মন্দির বিরল।

কলকাতার কাছেই ব্যারাকপুরের তালপুকুর অঞ্চলে রয়েছে একটি অন্নপূর্ণা মন্দির, যা দেখতে অবিকল দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মতো। মন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে এক কাহিনি।

১৮৪৭-এ রানি রাসমণি তাঁর জামাই মথুরমোহন বিশ্বাস, আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য দাস-দাসীকে সঙ্গে নিয়ে কাশীযাত্রা করেছিলেন। রাতে নৌকায় তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান, কাশী না গিয়ে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করতে। এর পরে রানি কাশী যাত্রা স্থগিত করে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৫৫ সালে।

শোনা যায়, কাশীর অন্নপূর্ণা দর্শনে বিঘ্ন ঘটায় সেই থেকেই রানি রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের মনে ইচ্ছে ছিল দেবী অন্নপূর্ণার মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। তাঁর জীবদ্দশায় না হলেও সেই স্বপ্নপূরণ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী, রানি রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বাদেবী। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠার ঠিক ২০ বছর পরে ১৮৭৫-এর ১২ এপ্রিল চাণক-এ অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। এই চাণকই হল আজকের ব্যারাকপুর। মন্দির প্রতিষ্ঠার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁদের পুত্র দ্বারিকানাথ বিশ্বাস। তৈরি হয়েছিল পঙ্খের কাজ যুক্ত ন’টি চূড়া বিশিষ্ট নবরত্ন মন্দির, বৃহৎ নাট মন্দির, ছ’টি আটচালার শিবমন্দির, দু’টি নহবৎখানা, গঙ্গার ঘাট, ভোগের ঘর ইত্যাদি। এতে সে যুগে খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ টাকা। ছ’টি শিব মন্দির যথাক্রমে কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর, ও কপিলেশ্বর।

দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের চেয়ে এই মন্দির উচ্চতায় কিছুটা বেশি হলেও দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে কিন্তু কম। মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিব ও অন্নপূর্ণার বিগ্রহ অষ্টধাতুর তৈরি। দেবীকে পরানো হয় বেনারসি শাড়ি ও স্বর্ণালঙ্কার। দেবীর চালচিত্র ও সিংহাসন রুপোর তৈরি। প্রতি মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বিশেষ পুজো হয়। মন্দিরে প্রতি দিন অন্ন ভোগ হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, দেবী অন্নপূর্ণার ভোগে প্রতি দিন মাছ থাকা আবশ্যিক। মন্দিরে মূল অন্নকূট উৎসব হয় কালীপুজোর পরের দিন। এ ছাড়াও অন্নকূট হয় অন্নপূর্ণাপুজোর দিন। আগে পাঁঠাবলি হলেও এখন তা বন্ধ। তবে অন্নপূর্ণাপুজো ছাড়াও মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস (চৈত্র সংক্রান্তি), মঙ্গলচণ্ডী পুজো, বিপত্তারিণী পুজো, অম্বুবাচী, জন্মাষ্টমী, দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজোয় বিশেষ পুজো হয়ে থাকে।

নাটমন্দিরের থামে গথিক স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তা ছাড়া, মন্দিরের আর্চে দেখা যায় সূক্ষ্ম অলঙ্করণ ও নকশা। কথিত আছে, মন্দিরের প্রবেশপথের তোরণের উপর যে সিংহটি রয়েছে, সেটি সরিয়ে ফেলার জন্য এক সময় ব্রিটিশ প্রশাসন মন্দিরের উপর নানা রকম চাপ সৃষ্টি করেছিল। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে আদালতের রায়ে সেটি যথাস্থানেই রয়ে গিয়েছিল। মন্দিরের কাছেই চাঁদনি রীতির গঙ্গার ঘাট যা রানি রাসমণি ঘাট নামেই পরিচিত। শোনা যায় এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণ স্নান করেছিলেন শিখ সৈন্যদের সঙ্গে।

মন্দিরের নিত্যসেবা ও পুজো-পার্বনের ব্যয় বহনের জন্য জগদম্বাদেবী সেই সময়ে উপযুক্ত সম্পত্তি দিয়ে ‘অর্পণনামা’ করেছিলেন। সেই ‘অর্পণনামা’-র নির্দেশ অনুসারে ‘জ্যেষ্টানুক্রমে’ বংশের বয়োজ্যেষ্ঠকে মন্দিরের সেবায়েত হতে হয়। শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির ও দেবোত্তর এস্টেটের ম্যানেজিং সেবায়েত অলোককুমার বিশ্বাস বলছিলেন, “এই মন্দিরে মোট চার বার এসেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ। মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষেও তিনি উপস্থিত ছিলেন।” মন্দির প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “আমি চাণকে অন্নপূর্ণা প্রতিষ্ঠার সময় দ্বারিকবাবুকে বলেছিলাম বড় দীঘিতে মাছ আছে গভীর জলে। চার ফেল, সেই চারের গন্ধে ওই বড় মাছ আসবে। এক একবার ঘাই দেবে। প্রেমে ভক্তিরূপ চার।” (কথামৃত, ৫ম ভাগ, দ্বাদশ খণ্ড, ৫ম পরিচ্ছেদ।)


শিব ও অন্নপূর্ণার বিগ্রহ

এই মন্দিরের সেবায়েত রাজশ্রী বিশ্বাস জানালেন, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে মন্দিরের আয় কমতে থাকে। দেবোত্তর এস্টেটের উদ্যোগে মন্দিরে নিত্যপুজো ও সেবা হলেও আর্থিক সমস্যা তৈরি হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নিয়ে। ঐতিহাসিক এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে আজও মেলেনি কোনও সরকারি সহায়তা। পুজো-পার্বনে ভক্ত সমাগম হলেও অন্যান্য দিনে খুব কম সংখ্যক মানুষের আনাগোনা এই মন্দিরে।

প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ব্যারাকপুরের গাঁধীঘাট কিংবা মঙ্গল পাণ্ডের স্মৃতিসৌধ দেখতে এলেও, এগুলির অদূরে থাকা বাংলা মন্দির স্থাপত্যের এই উল্লেখযোগ্য কীর্তিটি রয়ে যায় চোখের আড়ালেই। আজও ব্যারাকপুরে ঐতিহাসিক অঞ্চলকে নিয়ে গড়ে ওঠেনি কোনও পরিকল্পনা বা ভ্রমণ প্যাকেজ।

বিটি রোড ধরে ব্যারাকপুর কিংবা টিটাগড়ের মাঝামাঝি তালপুকুর বাসস্টপে নেমে রিকশায় বা হাঁটা পথে মিনিট সাতেকে পৌঁছনো যায় এই মন্দিরে।

—নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE