জীবন এত ছোট কেনে— প্রশ্ন তুলেছিল উপন্যাসের চরিত্র। আর জীবনের সুদীর্ঘ সময় কারাগারে কাটিয়ে ফেলা অনেক বন্দিরই আর্ত জিজ্ঞাসা, প্যারোল এত ছোট কেন?
সংস্কারের সুবাদে জেল এখন হয়েছে ‘সংশোধনাগার’। একই ভাবে প্যারোল ব্যবস্থার সংস্কার হবে না কেন, সেই প্রশ্নতাড়িত ভাবনা থেকেই বন্দিদের বয়স, পারিবারিক পরিস্থিতি ও আচার-ব্যবহার যাচাই করে প্যারোলে মুক্তির সময়সীমা বাড়াতে চাইছে কারা দফতর। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের এখন ১০ দিনের বেশি প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয় না। কারা দফতরের যুক্তি, সুদীর্ঘ কারাবাসের ফলে বহু বন্দি শারীরিক ও মানসিক ভাবে জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তাঁরা আর জেলে থাকলেন কি থাকলেন না, তা নিয়ে কার্যত কিছুই যায়-আসে না সমাজের। তাই প্যারোলে মেয়াদ বাড়ালে মুক্তির স্বাদ পায় ক্ষয়ে আসা প্রাণ।
প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা আছে আইন ও বিচার দফতরের হাতে। তাই বিচারসচিব বিবেক চৌধুরীকে চিঠি লিখে প্যারোলের সময়সীমা বাড়াতে অনুরোধ করেছেন ডিজি (কারা) অরুণ গুপ্ত। বিচার দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘কারা দফতর যদি কাউকে দীর্ঘ প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার কথা বিবেচনা করে, তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তবে এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকেই।’’
কারা দফতরের প্রস্তাব: ১৮ বছর সাজা খেটেছেন, এমন বন্দিদের টানা ১০ মাস বাড়িতে থাকার অনুমতি দেওয়া হোক। ১৭ বছরের ক্ষেত্রে ছ’মাস, ১৬ বছরের ক্ষেত্রে চার মাস এবং বন্দিদশার ১৫ বছর পূর্ণ হলে দু’মাসের প্যারোল দেওয়া হোক আবেদনকারী বন্দিদের। তবে কম মেয়াদের প্যারোলের মতো এ ক্ষেত্রেও মুক্ত থাকাকালীন ১৫ দিন অন্তর স্থানীয় থানায় হাজিরা দেওয়ার নিয়মবিধির বাধ্যবাধকতা বলবৎ রাখতে চাইছে কারা দফতর।
এক কারাকর্তা জানান, রাজ্যের বিভিন্ন জেলে এখন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি আছেন ৩১৫১ জন। তাঁদের মধ্যে ৪০৫ জন জেলে ১৪ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। ২০ বছর বা তারও বেশি কারাজীবন কাটিয়েছেন ৬৭ জন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছেন। কেউ চোখে কম দেখেন। কানে কম শোনেন কেউ কেউ। জরা থাবা বসিয়েছে তাঁদের শরীরে। এমনই শারীরিক অক্ষমতা ও মানসিক অবসাদ নিয়ে যাঁরা উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপে দিন গুনছেন, তাঁদের দীর্ঘ প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করছে কারা দফতর। ‘‘সরকার আমাদের প্রস্তাব মেনে নেবে, এটা ধরে নিয়ে বিচার দফতরের কাছে ২২ বন্দির তালিকাও পাঠানো হয়েছে। ওই বন্দিরা কখনও কখনও প্যারোলে বেরিয়েছেন এবং ঠিক সময়ে জেলে ফিরেও এসেছেন। তাই ওঁদের উপরে আমাদের আস্থা বেশি,’’ বললেন ওই কারাকর্তা।
প্যারোলে মুক্তির মেয়াদ দীর্ঘতর করার এই ভাবনা কেন?
কারাকর্তাদের বক্তব্য, গত তিন বছরে প্যারোলে মুক্ত বন্দিদের আচার-আচরণে তাঁদের আস্থা বেড়েছে। ২০১২ থেকে এ-পর্যন্ত মাত্র ন’জন বন্দি কথা রাখেননি। মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, গুজরাত ও হরিয়ানায় ওই সময়ে জেল থেকে বেরিয়ে ফিরে না-আসার সংখ্যাটা একশোরও বেশি।
কারা-বিধিতে নির্দিষ্ট ভাবে বলা না-থাকলেও এক জন বন্দিকে বছরে এক বারই প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রথা চলে আসছে। কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের সুপার বলেন, ‘‘খোঁজখবর নিতে জেলের ভিতরে ঢুকলে পা জড়িয়ে ধরেন সত্তরোর্ধ্ব বন্দিরা। তাঁদের আর্তি একটাই, শেষ জীবনটা নাতি-নাতনির সঙ্গে কাটাতে চান। কাঁদতে থাকেন ওঁরা। কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে, আমার হাত-পা বাঁধা।’’
মুক্তির আবেদন যে সব ক্ষেত্রে বন্দিদের কাছ থেকেই আসে, তা নয়। তাঁদের বাড়ির লোকেরাও আর্জি জানান। তাঁরাও চান, ঘনিষ্ঠদের বন্দিদশা শেষ হোক। এক কারাকর্তার কথায়, ‘‘দীর্ঘ বন্দিজীবন কাটিয়ে ওঁরা (বয়স্ক সাজাপ্রাপ্তেরা) যে-বয়সে পৌঁছেছেন, সেই অবস্থায় জেলে থাকলে বা না-থাকলে সমাজের কিছু যায়-আসে না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে দেখা গিয়েছে, পাড়াপড়শিরা সংশ্লিষ্ট অপরাধীর কথা ভুলেই গিয়েছেন। সেই জন্যই দীর্ঘ প্যারোলের প্রস্তাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy