Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চর আসফাক নজরেই ছিল নবান্নর

আসফাক আনসারি যে পাকিস্তানের চর, সে কথা বেশ কিছু দিন ধরেই জানত রাজ্য সরকার। তিন মাস ধরে তাকে নজরে রেখেছিল কলকাতা পুলিশ। বন্দর এলাকা থেকে ধৃত তিন সন্দেহভাজন পাক চরের সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। ধৃত আসফাক তৃণমূলের ছাত্র নেতা এবং বন্দরের কর্মী ইরশাদ তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য বলে জানা গিয়েছে।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:০৩
Share: Save:

আসফাক আনসারি যে পাকিস্তানের চর, সে কথা বেশ কিছু দিন ধরেই জানত রাজ্য সরকার। তিন মাস ধরে তাকে নজরে রেখেছিল কলকাতা পুলিশ।

বন্দর এলাকা থেকে ধৃত তিন সন্দেহভাজন পাক চরের সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। ধৃত আসফাক তৃণমূলের ছাত্র নেতা এবং বন্দরের কর্মী ইরশাদ তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য বলে জানা গিয়েছে। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, ‘‘(বিষয়টি) অনেক আগেই জেনেছিলাম। সেই মতোই যা যা করার করা হয়েছিল। আমার কাছে রাজনীতির চেয়েও জাতীয় নিরাপত্তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’’

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বন্দরের চর-চক্রের এক পাণ্ডা যে তৃণমূলের ছাত্রনেতা সেটা নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির পক্ষ থেকে নবান্নকে জানানো হয়েছিল মাস তিনেক আগেই। জানামাত্র গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে আসফাক আনসারিকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ গিয়েছিল নবান্ন থেকে। সেই সঙ্গে চরচক্রের প্রত্যেক সদস্যকে দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আটঘাট বেঁধে নজরদারি চালানোর পরে রবিবার গ্রেফতার করা হয় আসফাক আনসারি, তার বাবা ইরশাদ এবং মামা জাহাঙ্গিরকে।

ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিরোধীরা যে ভাবে শাসক দলকে কাঠগড়ায় তুলেছে, তাতে খুবই বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি দাবি করেছেন, ইরশাদ ও আসফাক আগে সিপিএম করত। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে গার্ডেনরিচের মতো এলাকায় কে কী করছে, সব সময় তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু যে মুহূর্তে এই ঘটনা নজরে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ও গোয়েন্দারা ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেছে।’’ তাদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হয়নি বলেই সরকারের দাবি। মমতার ঘনিষ্ঠ এক নবান্ন-কর্তার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে তো নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত কোনও বিষয় প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সি জানে, দেড় বছর ধরে চলা এই অপারেশনে পূর্ণ মদত দিয়ে এসেছে রাজ্য।’’ নবান্নের সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছে দিল্লির গোয়েন্দা বাহিনীও।

প্রথমে মনে করা হচ্ছিল, উত্তরপ্রদেশ থেকে সন্দেহভাজন পাক চর ইজাজ ধরে পড়ার পরেই ইরশাদ-আসফাকদের কথা জেনেছে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। কিন্তু গোয়েন্দা সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে যে, ইজাজের ধরা পড়া এবং কলকাতায় ইরশাদ-জাহাঙ্গির-আসফাকের গ্রেফতারির পিছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী এবং কলকাতা এসটিএফের দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং নজরদারি। ইজাজকেই প্রথম নজর করতে শুরু করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। সেই সূত্রেই একে একে ইরশাদ-আসফাকদের গতিবিধি জানা যায়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি, ২০১৩ সালের শেষের দিকে ইজাজের সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন তাঁরা। গত বছর জুলাই মাসে ইজাজ এবং তার মডিউলের অন্য চাঁইদের ধরার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তখনই হঠাৎ ইজাজ কলকাতা ছেড়ে বরেলীতে চলে যায়। সেখানে ক্যান্টনমেন্টের পাশে ভিডিওগ্রাফির দোকান খোলে সে। তখন পরিকল্পনা বদল করে উত্তরপ্রদেশ এসটিএফের কাছে ইজাজ সম্পর্কে তথ্য পাঠান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তার পর থেকে ইজাজ এবং ইরশাদের মডিউলের উপর নজরদারি বাড়ায় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলি। জাল গুটিয়ে এনে গত অগস্ট মাসে কলকাতা এসটিএফ-কে পুরোটা জানায় কেন্দ্রীয় বাহিনী। তার পরেই নবান্নের নির্দেশে তিন জনকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত হয়।

অগস্ট মাসে খবর এলে গ্রেফতারে এত দেরি কেন? রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘গুপ্তচর মডিউলের কাজকর্মের হদিস পেতে প্রথমেই কাউকে গ্রেফতার করা হয় না। নজরদারি চালানো হয়।’’ ওই কর্তা জানান, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা বলে আসফাককে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও তার উপর এসটিএফের কড়া নজরদারি ছিল। সব দিক নিশ্চিত করে তাদের ধরার ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবারই নবান্নের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘খাগড়াগড়ের মূল হোতাই হোক কিংবা রানাঘাট ধর্ষণ-কাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত— রাজ্য পুলিশই তাদের গ্রেফতার করেছে। বন্দরেও তাই-ই হয়েছে।’’ তবে গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্সের (জিআরএসই) মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা-সংস্থায় কী ভাবে চর ঢুকে পড়ে তথ্য পাচার করল, তার বিস্তারিত তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর মতে, পূর্ব ভারতে চরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত এত বড় চক্র আগে ধরা পড়েনি। গোয়েন্দা বিভাগের খবর, ২০০৩ সালে জিআরএসই-তে ঠিকা শ্রমিকের কাজে যোগ দেওয়ার দু’বছর পর থেকে নথি পাচার শুরু করে ইরশাদ। ২০০৮ সালে সংস্থার পরিকল্পনা বিভাগে পিওনের কাজ শুরু করে সে। এর পর থেকেই নথি পাঠানোর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। জেরায় সে জানিয়েছে, অফিসারেরা কোনও ফাইল মন দিয়ে পড়ছেন দেখলেই কর্তাদের অনুপস্থিতিতে তার ছবি তুলে নিত ইরশাদ। কর্তারা কোনও কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে দিলেও তা বাড়িতে নিয়ে এসে ফের জোড়া লাগাতো। অনেক সময় অফিসারেরা মেশিনে নথিপত্র ঢুকিয়ে নষ্ট করে দিতে বলতেন। ইরশাদ তা নষ্ট না-করে বাড়ি নিয়ে যেত। সুযোগ পেলেই যুদ্ধজাহাজের নকশা, ছবি তুলে পাকিস্তানে পাঠাতো বলে গোয়েন্দাদের জানিয়েছে সে।

এক গোয়েন্দা কর্তা জানান, জিআরএসই-র ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ এবং ২০ নম্বর প্রকল্পের সমস্ত নকশা ও পরিকল্পনা পাকিস্তানে পাচার হয়ে গিয়েছে। এগুলি ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্রিগেট, করবেট, ডেস্ট্রয়ার এবং টহলদারি ভেসেল তৈরির নকশা। গোয়েন্দাদের খবর, আসফাক ২০১৩ -এ দু’বার ঢাকা গিয়ে এক বার ৯০টি ছবি সম্বলিত একটি মেমোরি চিপ ও প্রায় দু’শো দস্তাবেজ পাচার করে। এ ছাড়া ইরশাদ নিজের ছেলের পরিচয় দিয়ে ইজাজকে দু’বার দু’টি অনুষ্ঠানে জিআরএসই-র ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে ছবি তুলেছিল ইজাজ। পাশাপাশি, মেরঠ এবং বরেলী ক্যান্টনমেন্টের বহু ছবিও করাচিতে পাচার হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE