ছবি: রণজিৎ নন্দী।
সল্টলেকের মাঠের চিলতে কোণে বারাক হুসেন ওবামা-র ছায়া।
৮২ বছরের স্নিগ্ধ দিদিমা হেসে বলছেন, ‘‘আমি তো ইংরাজি জানি না, হিন্দিও জানি না! তবে কাঁথাখান দেখে ল-ম্বা লোকটা আমায় জড়ায়ে ধরেছিল।’’ দিল্লির প্রগতি ময়দানে ক্র্যাফ্টস মিউজিয়মের কিস্সা। আট বছর আগের ঘটনা। বীরভূমের নানুরের পাটনীল গাঁয়ের সবিহার বানুর হাতে বোনা নকশিকাঁথায় মুগ্ধ হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিনেও নেন তখনই। সবিহারের ডান চোখে ইতিমধ্যে ছানি কাটা হয়েছে। চোখে চশমা। কিন্তু ফ্রেম হাতে কাঁথার গায়ে মনের ছবি ফুটিয়ে তোলায় ছেদ পড়েনি। নিজে তো সচল আছেনই। মেয়ে, বউমা, নাতনি— সবাইকে নিয়ে পরম আদরে বাঁচিয়ে রেখেছেন ক্রমশ ভুলতে বসা বাংলার কাঁথাকাজের পরম্পরা।
গুজরাতের কচ্ছের ২২ বছরের তরুণের খ্যাতিতেও আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মহিমার ছটা। তাঁর স্মৃতি তুলনায় টাটকা। এই তো গত বছর অক্টোবরের ঘটনা। যখন তাঁদের পারিবারিক শিল্পকলা প্রাচীন ইরানি ঘরানার দুর্লভ রোগান চিত্রকলার স্মারক ওবামার হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২২ বছরের জব্বর খাতরি বলছিলেন, তাঁর দাদা আব্দুলগফুর খাতরি নিজে দিল্লিতে গিয়ে ‘মোদীজি’-র হাতে ছবির দু’টো ফ্রেম তুলে দেন। ওবামার জন্য উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শুধু শ্রীমদ্ভগবতগীতা বা গীতার উপরে গাঁধীজির ভাষ্যই ছিল না। কচ্ছের ইরানি ঘরানার এই চিত্রকলার নিদর্শনও মোদী ওবামার জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন। এই পরিবারটির হাতেই এখন টিকে রয়েছে কয়েকশো বছরের পুরনো রোগান চিত্রকলার বেটন।
সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের মাঠে রকমারি শিল্পঘরানার মেলায় পাশাপাশি দু’টো স্টলে কচ্ছের রোগান চিত্রকলা ও বীরভূমের কাঁথাশিল্পের সহাবস্থান। দু’জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে ওবামা-কাহিনি। দেশের পশ্চিম ও পুব প্রান্তের দু’টি পরম্পরাও যেন পরস্পরের হাত ধরল শিল্পকলার মেলা কারিগর-হাটে।
একুশ শতকের ক্যানভাসে এ সব প্রাচীন ঘরানার লড়াই করে টিকে থাকার রাস্তা বাতলে দিতে এগিয়ে এসেছে নাবার্ড। এইম (আর্ট ইলিউমিনেট্স ম্যানকাইন্ড)-বলে একটি সংস্থার আয়োজনে মেলার মাঠেই গ্রামীণ ভারতের লোকশিল্পীদের কাজ যুগোপযোগী করার তালিম দিচ্ছে তারা। নাবার্ড-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার চিফ জেনারেল ম্যানেজার রাজি গায়েনের মতে, ‘‘গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করার স্বার্থেই এই তালিম দরকার।’’
জব্বর খাতরির ‘বড়ে পাপা’ (জেঠামশাই) গফুরভাই খাতরিও এই সার কথাটা বুঝেছিলেন আশির দশকের শেষ দিকে। তখন থেকেই রোগান চিত্রকলা কী ভাবে আরও সূক্ষ্ম কারুকাজে পাল্টে ফেলা যায়, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার শুরু। ‘রোগান’ মানে তেল। ক্যাস্টর অয়েল ফুটিয়ে ঠান্ডা জলে মিশিয়ে তৈরি এক ধরনের থকথকে মণ্ডে নানা ধরনের রং মিশিয়ে এই শিল্পঘরানার জন্ম। সময়ের সঙ্গে কুর্তা-দোপাট্টার আঙ্গিকেও এই চিত্রশৈলী প্রতিষ্ঠা করেছে খাতরি পরিবার। ভুজ থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে খাতরিদের গ্রাম নিরোনা। ভূমিকম্পের ধাক্কায় টালমাটাল হয়েও হার মানেননি ওঁরা। ঘুরে দাঁড়ানোর পরে বরং ওই তল্লাটের কয়েকশো মেয়েকে তালিম দিয়েছেন। জব্বরের কথায়, ‘‘আমাদের বাড়ির তিন পুরুষের ন’জন এই শৈলীতে ওস্তাদ। কিন্তু নিজেদের মধ্যে তেলরঙের ঘরানা বাঁচবে না।’’
বীরভূমের বৃদ্ধা সবিহার বানুর রক্তেও তাঁর মা-নানির ঘরানা। শুধু যে ওবামাসাহেব দিল্লিতে ৮৫ হাজার টাকা দিয়ে তাঁর হাতের কাঁথা কিনেছেন, তাই নয়, কাঁথার কাজের কসরতেই জীবনভর অর্ধেক দুনিয়া ঘুরেছেন তিনি। বিয়ের সময়ে নানির মমতা-মাখা দেড়শো বছরের পুরনো সুজনি কাঁথাখানা ট্রাঙ্কবন্দি করে এনেছেন কলকাতাতেও। মেয়ে মমতাজ, কিশোরী নাতনি মাসুদা সুলতানাদের নিয়ে সে-কাঁথা খুলে দেখাতে দেখাতে সবিহার বলেন, ‘‘তখনকার সুতো হতো শাড়ির পাড় দিয়ে। আর ফুল-পাত্তির এই নকশা হল বাংলার কাঁথার আদি নকশা।’’ সেই আদি নকশাকে অদলবদল করেই কাঁথায় হাত পাকিয়েছেন এই পাড়াগেঁয়ে মা-দিদারা।
নানুরেও কয়েকশো মেয়েকে কাঁথাশিল্পে তালিম দেন সবিহার। গ্রামের নামমাত্র শিক্ষিত নারী ভাবেন, কী ভাবে বাংলার সাবেক নকশিকাঁথাকে সবার কাছে পৌঁছে দেবেন। কয়েক বছর আগে গোটা রামায়ণের উপরে কাজ শেষ করেছেন। ৫২টি ছবিতে রামের জন্ম থেকে সীতার পাতাল-প্রবেশের কাহিনি। হনুমানের রাম-সীতার প্রতি ভক্তির কথা বলতে গিয়ে চোখের কোণটা চিকচিক করে বৃদ্ধার। কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে সে-কাঁথা এখন ঠাঁই পেয়েছে।
কারিগর-হাটের মেলা-য় এখন পারিবারিক পরম্পরা অটুট রাখতে সামিল নানা লোকশিল্পের ছড়াছড়ি। পটচিত্র, মধুবনী, রায়বেঁশে নাচ, কথাকলি থেকে ঢাকবাজনের কলা। জব্বর বা সবিহান বানুর পরিবার অখ্যাত শিল্পীদের পথ চলার প্রেরণা হয়ে উঠেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy