—নিজস্ব চিত্র।
দামোদর শেঠ আজ ভাজা ভেটকি পাবেন, তাজা ভেটকিও পাবেন। তবে খুশি হবেন কি না সন্দেহ।
রবীন্দ্রনাথ লিখেই গিয়েছিলেন, দামোদর শেঠ অল্পেতে খুশি হওয়ার পাত্র নন। তাঁর মুড়কির মোয়া চাই, চাই ভেটকি মাছ ভাজাও। কিন্তু হালে ভেটকির স্বাদগন্ধ যেন বেবাক হাওয়া! সেই ভেটকি-ভাজা কি দামোদরকে খুশি করবে?
ভেটকি মাছের বিভিন্ন পদের জন্য ভোজনরসিকদের কাছে যুগ যুগ ধরে কুলীন হিসেবে গণ্য ভবানীপুরের একটি ক্যাটারার এবং তাদের রেস্তোরাঁ চেন। তাদের কর্ণধার তপন বারিকও বলছেন, ‘‘সেই ভেটকি আজ আর নেই। বহু কিছুর মতো ভেটকি মাছেও অবক্ষয়।’’ কী রকম? তপনবাবুর কথায়, ‘‘আমাদের ভেটকি ফ্রাই পাতে পড়ার পর ভাঙলেই ভুস করে ধোঁয়া আর জিভে জল আনা গন্ধ ভুরভুরিয়ে বেরিয়ে আসত। সেই সঙ্গে লেবুর কোয়ার মতো ফাইবার। এগুলোই ভেটকির জাত চিনিয়ে দেয়। এখন এক হাজার ভেটকির মধ্যে বড়জোর একটা ভেটকি জাতের হয়।’’
ভেটকি কেন তার জাত হারাল? কেন্দ্রীয় নোনা জলজীব পালন অনুসন্ধান সংস্থার কাকদ্বীপ গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানী গৌরাঙ্গ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ভেটকির চাষ এখন প্রচুর বেড়েছে। ওই সব জলাশয়ে অপ্রাকৃতিক খাবার দেওয়া হচ্ছে মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য। মাছের পুষ্টি হচ্ছে না। তাই, স্বাদও হারিয়ে যাচ্ছে।’’
রাজ্য মৎস্য উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান বিজনকুমার মণ্ডলও জানাচ্ছেন, দূষণের কারণে সমুদ্র উপকূলে বা নদীতে ভেটকি আর মিলছে না। বছর দশেক আগেও পশ্চিমবঙ্গের সাগর থেকে নদিয়া পর্যন্ত নদীতে যে সব ভেটকির দেখা মিলত, এখন তারা উধাও। অথচ চাহিদা প্রবল। ‘‘ফলে, সেই চাহিদা মেটাতে ভেটকির উপযুক্ত নয়, এমন জলেও ভেটকির চাষ হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই সেই ভেটকির স্বাদ তেমন নেই।’’
জাতকুলগোত্রহীন এই ভেটকির ফ্রাই কি আদৌ মুখে তুলতেন নিখিল?
নিখিল। বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসের নায়ক। ‘...শাশ্বতী, খয়েরি শার্ট দেখে দাঁড়িয়ে বললো, ভালো ক’রে খাচ্ছো তো, নিখিল? এক টুকরো ভেটকি-ফ্রাই মুখে তুলতে গিয়ে নিখিল ঘাড় ফেরালো...।’
ওই উপন্যাসের সময়কাল ১৯৪৮-৪৯। ইংরেজ আমলেও এ রাজ্যে ভেটকি ফ্রাইয়ের ভাল রকম চল ছিল। বিলেতে ফিশ অ্যান্ড চিপস খুবই জনপ্রিয় ডিশ। সেখানে কড ও হ্যাডক থেকে ‘ফিলে’ কেটে ব্যাটারে ডুবিয়ে ভেজে সেই পদ বানাতে হয়। কিন্তু এ দেশে ও-সব মাছ নেই। অতএব ভেটকির ফিলে বার করেই ভাজা খেতে শুরু করেন সাহেবরা। ভেটকিকে ডাকতে শুরু করেছিলেন ‘বেকটি’ বলে।
বাঙালি রসনাতেও ভেটকির আলাদা আদর। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি ভ্রমণ কাহিনিতে রয়েছে, বেশ কিছু দিন পাহাড়ে ঘুরে লেখক নেমে এলেন সমতলভূমিতে। ক’দিন নিরামিষ খেয়ে কাটাতে হয়েছে। কখনও চানা বাটুরা, কখনও খিচুড়ি, কোনও দিন স্রেফ কালাকাঁদ। সমতলে নেমেই একটা বড় রেস্তোঁরা বেছে নিয়ে লেখক অর্ডার করলেন— ভাত, মুগের ডাল আর ভেটকি ফ্রাই!
দেশপ্রিয় পার্কে এক বনেদি বাড়ির মেয়ের বিয়ে। রাতের মেনুতে থাকা ভেটকির একটি রসালো পদের জন্য দুপুরেই মাছ ভেজে তুলে রাখছেন রাঁধুনে। গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল সেই অনির্বচনীয় সুবাস। দুপুরে খেতে বসে ভোজনের আয়োজক, কনের সহপাঠীকে অনেকের আকুতিমাখা প্রশ্ন, ‘‘এখন ফ্রাই নেই বুঝি?’’
আর সেই ভেটকিকে এখন কিনা অনেক সময়ে বিলিতি পাঙাস বা বাসা বলে বিভ্রম হয়!
অতীতে দুই ২৪ পরগনার সমুদ্র উপকূলবর্তী লাগোয়া নদীর খাড়ি, মোহনায় ভেটকি মিলত। উপকূলবর্তী এলাকায় জোয়ারের জল বাঁধ দিয়ে ভেটকির চাষ করা হতো। সেই সময়ে চাষে ভেটকির খাবার হিসেবে রাখা হতো চিংড়ি। কিন্তু মৎস্য দফতরের বিজ্ঞানীদের একাংশ জানাচ্ছেন, এখন চিংড়ির জায়গা নিয়েছে কৃত্রিম খাদ্য।
রাজ্য মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অর্থনীতি ও পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সোমেন সাহুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘দুই চব্বিশ পরগনার উপকূলবর্তী এলাকায় যেটুকু ভেটকি সমুদ্র থেকে ধরা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই রফতানি হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের রাজ্যে আসল ভেটকির অভাব দেখা দিয়েছে। পরিবর্তে বাজার দখল করেছে অনুপযুক্ত জলের ভেড়িতে, কৃত্রিম খাবার খেয়ে বড় হওয়া ভেটকি।’’
কলকাতার বিভিন্ন বাজারের আড়তদাররা জানাচ্ছেন, বছর দশেক আগেও ভেটকির ৮০ শতাংশই চিল্কা ও দুই চব্বিশ পরগনার সমুদ্র উপকূল থেকে আসত। এখন সেই ভেটকি আসে মাত্র ২০ শতাংশ। আড়তদারদের অন্যতম বিজয় সিংহ বলেন, ‘‘চিল্কা থেকে পাতিপুকুর ও শিয়ালদহের বাজারে রোজ এক টন ভেটকি আসত। এখন কমে দাঁড়িয়েছে একশো থেকে দেড়শো কেজিতে।’’
মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, এখন যে ভাবে চাষ হচ্ছে, সেই ভেটকি খাওয়ার অর্থ, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। বিজনবাবু অগত্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘‘পোলট্রির ব্রয়লার মুরগি তো মুরগি বলেই খাচ্ছেন! সেই ভাবে ভেটকিকেও গ্রহণ করতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy