Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জঙ্গি মডিউলের প্রধান আঁতুড়ঘর বীরভূমই

জঙ্গিদের ‘সফ্ট টার্গেট’ ভারতের রাষ্ট্রপতির দিদির বাড়ি কীর্ণাহারে। যে তল্লাট বীরভূম জেলায়। আর এই বীরভূমই খাগড়াগড়-কাণ্ডের সূত্রে হদিস মেলা জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীর প্রধান আঁতুড়ঘর ছিল বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মতে, জঙ্গিদের অনেকেই যেখানে বীরভূম থেকে নিযুক্ত হয়েছে, সেখানে অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হামলার লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়াটা তাঁদের পক্ষে সহজ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৫
Share: Save:

জঙ্গিদের ‘সফ্ট টার্গেট’ ভারতের রাষ্ট্রপতির দিদির বাড়ি কীর্ণাহারে। যে তল্লাট বীরভূম জেলায়। আর এই বীরভূমই খাগড়াগড়-কাণ্ডের সূত্রে হদিস মেলা জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীর প্রধান আঁতুড়ঘর ছিল বলে জেনেছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের মতে, জঙ্গিদের অনেকেই যেখানে বীরভূম থেকে নিযুক্ত হয়েছে, সেখানে অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হামলার লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়াটা তাঁদের পক্ষে সহজ। কিন্তু, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের আগে এর বিন্দুবিসর্গ টের পাওয়া গেল না কেন, তা ভাবিয়ে তুলেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের।

এক জন, দু’জন নয়শুধু বীরভূম থেকে অন্তত ছ-সাত জন সন্দেহভাজন জঙ্গির নাম উঠে এসেছে খাগড়াগড়-তদন্তে। পাশাপাশি, বোলপুর, মহম্মদবাজার ও কীর্ণাহারমূলত বীরভূমের এই তিন এলাকা গোয়েন্দাদের রেডারে রয়েছে। কারণ ইতিমধ্যেই তদন্তে জানা গিয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দিদি অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় (কীর্ণাহারের পরোটা গ্রামে বাড়ি) ছিলেন জঙ্গিদের নিশানায়। এই তথ্য সামনে আসার পরে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বীরভূম-যোগটি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।জেহাদি-যোগের জেলা হিসাবে এ রাজ্যে এত দিন বারবার শোনা গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার কথা। এই তিনটি জেলাই বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। কিন্তু, বীরভূম বা বর্ধমান? সেখানে তো কোনও আন্তর্জাতিক সীমান্ত নেই! অথচ, বর্ধমান বিস্ফোরণের পরে মুশির্দাবাদের বেলডাঙা ও ডোমকল এবং নদিয়ার করিমপুরের মতোই সরাসরি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে বর্ধমানের মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া বা বীরভূমের কীর্ণাহারের নিমড়া-কাফেরপুর-পরোটা, বোলপুরের মুলুক গ্রামের শান্তিপল্লি এবং মহম্মদবাজারের ডেউচার নাম। বিস্ফোরণের দিন নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গি করিম শেখ (সুবহান মণ্ডল) এবং জখম আব্দুল হাকিম, দু’জনেই এই জেলার বাসিন্দা। প্রথম জনের বাড়ি কাফেরপুর গ্রামে। দ্বিতীয় জন ডেউচার বাসিন্দা। বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পাচারের অভিযোগে এনআইএ যাকে গ্রেফতার করেছে, সেই আমজাদ শেখের (কাজল) বাড়ি কীর্ণাহারের কাজি মার্কেট এলাকায়। এই আমজাদ আবার নিহত করিমের পিসতুতো ভাই।

এখানেই শেষ নয়, খাগড়াগড়ের মূল চক্রী বলে যাকে ভাবা হচ্ছে, সেই সাজিদ শেখ (কয়েক দিন আগে ধৃত) কিন্তু বুরহান শেখ নামে কীর্ণাহার থেকেই ভোটার কার্ড-সহ বিভিন্ন পরিচয়পত্র তৈরি করিয়েছিল। অন্য দিকে, ঘটনার পর থেকেই বেপাত্তা হয়ে যাওয়া আরও চার সন্দেহভাজন জঙ্গির ঠিকানাও এই বীরভূমই। যাদের সন্ধান চেয়ে ইতিমধ্যেই ওয়েবসাইটে কয়েক লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে এনআইএ!

ঘটনা হল, কীর্ণাহারের যে পরোটা গ্রামে রাষ্ট্রপতির দিদির বাড়ি, সেখান থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার দূরে নিমড়া গ্রামের মাঠপাড়ায় শ্বশুরবাড়ি ছিল খাগড়াগড়-কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত, জামাত সদস্য কওসরের। স্ত্রী জিন্নাতুর ওরফে লক্ষ্মীকে নিয়ে এই বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত সে। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরেই নিমড়া গ্রামের বাড়ি থেকে সপরিবার উধাও হয়ে যায় কওসরের শ্যালক কদর গাজি। এই কদরের নামও কওসরের সহযোগী হিসাবে তদন্তে উঠে এসেছে। পরোটা থেকে কীর্ণাহারের কাজি মার্কেট (ধৃত আমজাদের বাড়ি) আবার আধ কিলোমিটার দূরে। আর কাফেরপুরের দূরত্ব বড়জোর তিন কিলোমিটার।

কেন বীরভূম থেকেই জঙ্গি নিয়োগ?

এই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদেরও। উত্তর খুঁজতে গিয়ে গোয়েন্দারা ধন্দ ক্রমশ কাটিয়ে উঠছেন। তাঁরা মনে করছেন, বর্ধমান ও মুশির্দাবাদ থেকে সড়ক পথে বীরভূমের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই কাজে লাগায় সন্দেহভাজন জঙ্গিরা। তারই সূত্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে জঙ্গিরা অল্পবয়সী যুবকদের ‘রিক্রুট’ করে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। ভৌগোলিক অবস্থানগত এই সুবিধার জন্য বাংলাদেশ সীমানা লাগোয়া না হয়েও জঙ্গিদের কাছে ‘সেফ প্যাসেজ’ হয়ে উঠেছিল বীরভূম। এমনটাই মনে করছেন গোয়েন্দারা।

বিস্ফোরণ-কাণ্ডের পরেই ধৃত রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিকে জেরা করে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, বিস্ফোরণে আর এক সন্দেহভাজন জঙ্গি হবিবুর শেখের (কওসরের সঙ্গী) বাড়ি বোলপুরের মুলুক গ্রামের শান্তিপল্লিতে। তদন্তে আরও জানা যায়, বর্ধমান শহরের বাবুরবাগের যে বাড়িতে কওসরের মূল ডেরা ছিল, হবিবুরই সেই বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিল। হবিবুরের সঙ্গে সেখানে কওসর এবং তার স্ত্রী জিন্নাতুর থাকত। নিজের দুই বোনের সঙ্গে কওসর ও হবিবুরের বিয়ে দিয়েছিল নিমড়ার কদর গাজি। কওসরকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি কদর নিজের একটি মোটরবাইকও ব্যবহার করতে দিয়েছিল। এই মোটরবাইক কওসর বিস্ফোরক পাচারের কাজে লাগিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। বিস্ফোরক তৈরি করতে কলকাতা থেকে রাসায়নিক এনে দেওয়ার কাজ করত আমজাদ বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

গোয়েন্দাদের নজরে রয়েছে মুলুক গ্রামের শান্তিপল্লিও, যেখানে বাড়ি হবিবুরের। গোয়েন্দারা জেনেছেন, হবিবুরের ঘনিষ্ঠ ডালিম শেখ (যে নিজেও সপরিবার পলাতক) শান্তিপল্লি লাগোয়া ‘লাদেনপট্টি’তে তিন বহিরাগতকে থাকার বন্দোবস্ত করে দেয়। ওই সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা এলাকায় নিজেদের বাসনের ফেরিওয়ালা হিসাবেই পরিচয় দিয়েছিল। ওই তিন জনের মধ্যে আব্দুল মালেক এবং তালহা শেখের বাড়ি থেকে এনআইএ বেশ কিছু সন্দেহজনক নথিও উদ্ধার করে। ইতিমধ্যেই ফেরার এই তালহার নামে এনআইএ ১০ লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে। লাদেনপট্টির একাংশে রীতিমতো অস্ত্রশিক্ষার ঘাঁটিও বানানো হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE