বিপন্ন-অতিথি: এ ভাবেই ধরা পচ্ছে বাগেরি পাখি। ফাইল চিত্র
বিপদ বুঝে বছর আটেক আগেই সতর্ক করেছিলেন পক্ষীপ্রেমীরা। তার পরেও যে ছবিটা একচুলও বদলায়নি, বরং দুষ্কর্মের চেহারাটা ক্রমশ মাত্রাছাড়া হচ্ছে— বুধবার রাতেই ফের তার প্রমাণ মিলল।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বাগেরি বা ভড়ুই নামে পরিচিত এক পরিযায়ী পাখির (শর্ট-টোড লার্ক) চোরাশিকার রুখতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হামলার শিকার হলেন খোদ বনকর্মীরাই। বুধবার রাত ৯টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে বোলপুর থানার সিয়ান এলাকার নামো মাঠে। বনকর্মীদের মারধর করে চোরাশিকারিরা পালাতে সক্ষম হলেও ঘটনাস্থল থেকে কয়েকশো বাগেরি পাখি উদ্ধার করেছে বন দফতর। জাল থেকে মুক্ত করে তাদের ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার বা আটক হয়নি।
বন দফতর সূত্রের খবর, শীতকাল কাটাতে সুদূর রাশিয়া, চিন ও মঙ্গোলিয়ার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে ঝাঁকে ঝাঁকে লক্ষ লক্ষ বাগেরি পাখি দক্ষিণবঙ্গের সমতল এলাকার ধানজমি, বিলে নেমে আসে। ছ’মাস মতো কাটিয়ে ফিরে যায় মার্চ-এপ্রিল নাগাদ। সাধারণত চাষ না হওয়া ধান কেটে ফেলা জমিতে এক ধরনের পোকা খায় আকারে চড়ুইয়ের থেকে সামান্য বড় এই পাখি। বীরভূম বন দফতরের ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন (সাম্মানিক) ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় জানান, ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে বীরভূম-মুর্শিদাবাদ জুড়ে একটা বড় চক্র তৈরি হয়েছে ওই পাখি চোরাচালানের। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, কাঁদি, বহরমপুরের মতো এলাকা থেকে পেশাদার চোরা শিকারিরা ৫-৮ জন করে দল বেঁধে এসে বোলপুরের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ক্যাম্প করে। বাগেরি পাখি সূর্যাস্তের সময় তারা ওই এলাকায় কুয়াশা জাল (এ ধরনের বিশেষ সরু জাল, যা সহজে নজরে পড়ে না) পেতে রাখে। রাতেই মাটিতে বসা মাত্রেই কুয়াশা জালে পরিযায়ী পাখিরা আটকে যায়। বোলপুর থানা এলাকার বারা ও সিয়ান, লাভপুরের কোমোদপুর ও শাউগ্রাম বাগেরি ধরার জন্য শিকারিদের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত।
বন্যপ্রাণ রক্ষা আইন ১৯৭২ অনুযায়ী এই পাখির শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বিগত কয়েক বছর বীরভূম-মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়ার একাংশে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছি। পক্ষীপ্রেমীদের দাবি, ২০১৫ সালে শুধু বীরভূমেই প্রায় আড়াই লক্ষ বাগেরি চোরাশিকারিদের কবলে পড়েছে। অভিযোগ, বীরভূমে ধরা পড়া বাগেরির একটা বড় অংশই পড়শি মুর্শিদাবাদের বাজারে বিক্রির জন্য চালান হয়ে যায়। দাম— ডজনে আড়াইশো। কেবল গ্রামীণ হাটেই নয়, বহরমপুর, কৃষ্ণনগরের মতো জেলা সদরে মোবাইলে অর্ডার দিলেও শালপাতা মুড়ে ওই পাখি দিব্যি বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ক’বছরেই গোটা কারবারটি এতটাই গোছানো হয়ে উঠেছে। ছোট্ট পাখিগুলো নিয়ে বিক্রির রমরমা তেমন প্রকাশ্যে না হলেও চুপিসারে ফিরে এসেছে কান্দি-বেলডাঙার গঞ্জেও। এমনকী অভিযোগ, বহরমপুর-সহ মুর্শিদাবাদের বহু হোটেলের মেনুতে প্রকাশ্যেই রয়েছে ভড়ুই।
এত কাণ্ডের পরেও কী করছে বন দফতর?
এ বছর এখনও তেমন তৎপরতা দেখা মুর্শিদাবাদ বন দফতরের। অভিযোগ, খবর পেয়েও গাঁয়ের হাটে পা পড়েনি বনকর্মীদের। যদিও বেলডাঙার বড়ুয়া মোড়ে ভড়ুইয়ের খোঁজে দিন কয়েক আগে হানা দিয়েছিল স্থানীয় থানার পুলিশ। সে বার পাখি ফেলেই পালিয়েছিল বিক্রেতা। আর মাঠে পরিযায়ী পাখি ধরতে ফাঁদ পাতা চলছে খবর পেয়ে বুধবার রাতে অভিযানে নামে বীরভূম বন দফতর। বোলপুরের রেঞ্জার নির্মলকুমার বৈদ্যের নির্দেশে বিট অফিসার শ্যামাকৃষ্ণ মণ্ডলের নেতৃত্বে বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে যান। নির্মলবাবুর কথায়, “পরিযায়ী পাখি শিকারের জন্য ফাঁদ পাতা ছিল। পাখি সমেত দু’জনকে হাতেনাতে ধরাও হয়। কিন্তু তারা বন কর্মীদের জখম করে চম্পট দেয়। পরে চোরা শিকারিদের জালে ধরা পড়া শতাধিক বাগেরি উদ্ধার করে ছেড়ে দেওয়া হয়।’’ তাঁরা পুলিশে অভিযোগ করেছেন। অতিরিক্ত জেনা বনাধিকারিক বিজনকুমার নাথ বলছেন, ‘‘আমরা সতর্ক থাকিই। টহলদারিও বাড়িয়েছি। প্রতি বছর অভিযান চলে। সে কারণেই পাখিগুলি উদ্ধার করা গিয়েছে।’’
উদ্বেগ যদিও যাচ্ছে না ঊর্মিলাদেবীদের। তিনি বলছেন, ‘‘এত দূর থেকে উড়ে আসছে। ওরা আমাদের অতিথি। অথচ আমরা ওদেরই নিরাপত্তা দিতে পারছি না। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।’’
=
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy