প্রতীকী চিত্র।
কেউ বলছেন সংগ্রহে ঘাটতির কথা। কেউ অভিযোগ করছেন, শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহের আগ্রহই কমে গিয়েছে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের। কেউ আঙুল তুলেছেন সরকারি নির্দেশের দিকে। আবার কারও মতে, অন্যান্য পরিষেবার মতো রক্তকে ‘ফ্রি’ করে দেওয়ার মাসুল গুনতে হচ্ছে আমজনতাকে।
কারণ যা-ই হোক, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত পাওয়ার অলিখিত ‘নিয়ম’-এর জেরে এক তরুণী বধুর মৃত্যুর পরে সঙ্কটের চেহারাটা ফের বেআব্রু। রবিবার কল্যাণী মেডিক্যালের ওই ঘটনা নিয়ে সোমবার স্বাস্থ্যভবন কিছু ‘ব্যবস্থা’র কথা জানালেও কর্তারা হলফ করে বলতে পারেননি যে, ‘অলিখিত ‘নিয়ম’টিতে দাঁড়ি পড়বে। ‘ও পজিটিভ’ গ্রুপের রক্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও তা বধূটির পরিবারকে দেওয়া হল না কেন?
হাসপাতালের অন্দরেই অভিযোগ, রক্ত জোগাড়ের জন্য বাইরের ক্যাম্পে যেতে কর্মীদের ঘোরতর অনীহা। ‘বসে-বসে খাওয়া’র এই মানসিকতা থেকেই তাঁরা চেয়েছেন, দাতারা ব্যাঙ্কে এসে নিজেরাই রক্ত দিয়ে যান। তা হলে ভাঁড়ার ভর্তির জন্য দৌড়োদৌড়ি করতে হয় না। বস্তুত অধিকাংশ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কেই ছবিটা তা-ই। ইচ্ছে করে রক্তের আকাল তৈরির নালিশও শোনা যাচ্ছে চিকিৎসক মহলে।
রবিবারের ওই ঘটনার জেরে এ দিন কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে ‘শো কজ’ করেছে স্বাস্থ্যভবন। ঘটনাটিকে ‘মর্মান্তিক’ আখ্যাও দিচ্ছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য দফতরের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি পৃথা সরকারের কথায়, ‘‘মুমূর্ষু রোগীর সঙ্গে কোনও ভাবেই এ রকম করা যায় না। বাড়ির লোকজনকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু রক্ত না-পেলে রক্ত দেব না— এ শর্ত চাপানো যায় না।’’
রক্তদান আন্দোলনে জড়িতেরা অবশ্য স্বাস্থ্যভবনকে দুষছেন। ওঁদের অভিযোগ— রক্তের আকাল কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কর্তারা বিলক্ষণ জানেন। দুর্গাপুজোর সময়ে হাহাকার চলেছে। সময়ে রক্ত না-পেয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগী মারা গিয়েছেন। ওঁদের প্রশ্ন, ‘‘অধিকাংশ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কেই বলা হয়, ডোনর আনুন, তবেই রক্ত মিলবে। তা হলে এখন লোক দেখানো হা-হুতাশ করে কী লাভ?’’
ব্লাড ব্যাঙ্কের কী বক্তব্য?
কর্তাদের দাবি— এখন রক্তদান শিবির কম হওয়ায় সংগ্রহে টান। কলকাতার এক সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্ণধারের যুক্তি, ‘‘ভাঁড়ার তো চালু রাখতে হবে। তাই দাতা আনতে বলি। নচেৎ পরিষেবাই বন্ধ করে দিতে হয়।’’ যদিও ওয়েস্ট বেঙ্গল ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষের অভিমত, ক্যাম্পে গিয়ে রক্ত আনার ইচ্ছেটাই ব্লাড ব্যাঙ্কের কমে গিয়েছে। রবিবার ছাড়া অন্য দিন ক্যাম্প করার প্রস্তাব একাধিক ব্লাড ব্যাঙ্ক ফিরিয়ে দিচ্ছে। ‘‘কিন্তু শুধু এক দিনের রোজগারে কি সপ্তাহভর বসে খাওয়া যায়?’’— প্রশ্ন অপূর্ববাবুর।
এমতাবস্থায় প্রমাদ গুনতে শুরু করেছেন চিকিৎসকেরা। এনআরএসের এক সার্জন যেমন অপারেশনের পরে রোগীর পরিজনকে দু’ইউনিট রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। কোনও ব্লাড ব্যাঙ্কে পাওয়া যায়নি। এ দিকে রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে এগোচ্ছিল। প্রচুর চিৎকার-চেঁচামেচি করে রক্তের ব্যবস্থা করে রোগীকে সে যাত্রা বাঁচাতে পেরেছেন তিনি। ‘‘সব সময়ে এটা সম্ভব হচ্ছে না। খবর পাচ্ছি, বহু হাসপাতালে রক্ত না পেয়ে রোগীরা ধুঁকছেন।’’— বলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গে ৫৯টি রাজ্য সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক রয়েছে। সঙ্গে বেসরকারি ৩৫টি ও কেন্দ্রীয় সরকারি ১৬টি। তবু আকাল কেন?
‘‘কারণ অজস্র।’’— জবাব দিলেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার ডি আশিস। তিনি জানাচ্ছেন, সরকারি নির্দেশে, বিকেল পাঁচটার পরে আর রক্ত নেওয়া হয় না। কারণ, তখন আর লোক থাকে না। রাতে যত জরুরি-ই হোক, কেউ নিজের রক্ত দিয়ে প্রিয়জনের জন্য রক্তের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ‘‘তাতে রোগী মারা গেলেও কিছু করার নেই।’’— খেদ তাঁর। আবার রক্তদান আন্দোলনের কর্মী দীপঙ্কর মিত্রের পর্যবেক্ষণ, অপচয়ও হচ্ছে বিস্তর। কী রকম?
ওঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ডাক্তার হয়তো লিখলেন, তিন ইউনিট লাগবে। এক দিনে লাগবে না। তবু সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় পাওয়া যায় বলে অনেকে রিকুইজিশন স্লিপ দেখিয়ে এক সঙ্গে তিন ইউনিট নিয়ে যাচ্ছেন। পরে দেখা যাচ্ছে, এক ইউনিটেই কাজ চলে গেল।’’
অর্থাৎ, দু’ইউনিট স্রেফ নষ্ট। চিকিৎসকদের অধিকাংশও মেনে নিচ্ছেন, এমনটা আকছার হচ্ছে। পাশাপাশি তাঁরা এ-ও বলছেন, ‘‘নিশ্চিন্ত থাকতেই এক সঙ্গে তিন-চার ইউনিট আনতে বলা। কারণ গ্যারান্টি নেই যে, পরে লাগলে সময় মতো পাওয়া যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy