Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ফাইলের নকল ফেরত, জেরা চাইছে সিবিআই

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে বিতর্কিত লগ্নি সংস্থার মালিকানাধীন সংবাদপত্র রাখার সরকারি নির্দেশের ব্যাপারে সবিস্তার জানেন, এমন আধিকারিককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে ‘পাঠযোগ্য’ সংবাদপত্রের তালিকা বেঁধে দিয়ে সরকারের জারি করা বিজ্ঞপ্তিও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজর-জালে পড়েছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫১
Share: Save:

সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে বিতর্কিত লগ্নি সংস্থার মালিকানাধীন সংবাদপত্র রাখার সরকারি নির্দেশের ব্যাপারে সবিস্তার জানেন, এমন আধিকারিককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে ‘পাঠযোগ্য’ সংবাদপত্রের তালিকা বেঁধে দিয়ে সরকারের জারি করা বিজ্ঞপ্তিও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার নজর-জালে পড়েছিল। সিবিআই সূত্রে বলা হয়, ওই সব সংবাদপত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা তাদের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি, সংবাদপত্রগুলিকে ওই সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি লগ্নি সংস্থাগুলির কাছ থেকে কোনও সুবিধা পেয়েছিলেন কি না, তা-ও তদন্ত করে দেখা হবে। সেই কারণে গত ২৯ জানুয়ারি সিবিআইয়ের দুই অফিসার সল্টলেকের বিকাশ ভবনে জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার দফতরে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ফাইলে বিভিন্ন আধিকারিক কী ‘নোট’ দিয়েছিলেন তা জানতে চেয়ে নোটিস দিয়ে আসেন। কিন্তু সিবিআইয়ের নোটিস পাওয়ার পরে ওই ফাইলের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায়, সেটি বেপাত্তা। ৩১ জানুয়ারির আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম সেই খবর প্রকাশিত হয়।

এই অবস্থায় মাসখানেক আগে নিখোঁজ ফাইল নিয়ে বিধাননগর উত্তর থানায় কাছে মিসিং ডায়েরি করে গ্রন্থাগার দফতর। আদালতে একটি মামলা চলার কারণে ফাইলের সব কাগজপত্রই ফটোকপি করা ছিল। তার থেকেই একটি প্রত্যয়িত নকল তৈরি করে সিবিআয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ফাইল নিতে অস্বীকার করেন সিবিআই আধিকারিকেরা। তাঁরা জানিয়ে দেন, ওই ফাইলের ব্যাপারে আদ্যোপান্ত জানেন, এমন কোনও অফিসারের বয়ান রেকর্ড করতে চায় সিবিআই। এই বার্তা পেয়ে দফতরের অফিসাররা আতঙ্কে রয়েছেন বলে সরকারি সূত্রে খবর।

‘মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটাতে’ ২০১২ সালের ১৪ মার্চ জনশিক্ষা প্রসার দফতরের বিশেষ সচিব রামপদ বিশ্বাসের সই করা এক নির্দেশিকায় পাঁচটি বাংলা, একটি হিন্দি ও দু’টি উর্দু সংবাদপত্রের নাম উল্লেখ করে জানিয়ে দেওয়া হয়, এর বাইরে কোনও সংবাদপত্র সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে কেনা যাবে না। এই ৮টি কাগজের প্রায় সব ক’টাই ছিল শাসক দল তথা সরকারের অনুগত ও সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং বিতর্কিত লগ্নি সংস্থার মালিকানাধীন। যেমন, সরকারি তালিকার থাকা বাংলা দৈনিক ‘সকালবেলা’ ও হিন্দি ‘আজাদ হিন্দ’-এর মালিক ছিল সারদা গোষ্ঠী। ‘খবর ৩৬৫ দিন’ চালায় রোজ ভ্যালি সংস্থা, যার মালিক গৌতম কুণ্ডুকে সম্প্রতি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গ্রেফতার করেছে। ‘একদিন’ পত্রিকার মালিকানা তখন ছিল আইকোর গ্রুপের হাতে। পরে ওই তালিকায় আরও তিনটি সংবাদপত্রের নাম যোগ করে সরকার। তার মধ্যে থাকা বাংলা দৈনিক ‘কলম’-ও সারদা গোষ্ঠী কিনে নিয়েছিল।

সরকারি তালিকায় থাকা সংবাদপত্রগুলির সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। যেমন, ‘সংবাদ প্রতিদিন’ পত্রিকার তৎকালীসম্পাদক ও সহযোগী সম্পাদক দু’জনেই তখন ছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য। হিন্দি দৈনিক ‘সন্মার্গ’, উর্দু দৈনিক ‘আখবর-ই-মশরিক’ এবং ‘কলম’-এর সম্পাদকেরাও শাসক দলের রাজ্যসভা সদস্য।

গ্রন্থাগারে খবরের কাগজ রাখার নির্দেশ সংক্রান্ত ফাইল চাওয়ার ব্যাপারে সিবিআইয়ের বক্তব্য, ‘‘কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাবলিক লাইব্রেরিতে বিতর্কিত লগ্নি সংস্থার টাকায় চলা খবরের কাগজ রাখার নির্দেশ রাজ্য কেন দিল, সেটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।’’ সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, অর্থলগ্নি সংস্থার টাকা খবরের কাগজের ব্যবসায় ঢুকেছিল, এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সেই টাকা কোথায় গেল তা খুঁজে বের করতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারির ঘটনাক্রম জানা দরকার। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, ‘‘সারদা-রোজভ্যালির মতো কোম্পানির কাগজ লাইব্রেরিতে রাখা বাধ্যতামূলক করা হল ঠিক কার নির্দেশে, সেটা আমরা খতিয়ে দেখতে চাই। কাউকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য এখানে কাজ করেছে কি না, তা-ও যাচাই করা দরকার।’’

আর এই যাচাই পর্বের তদন্তে নেমেই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে সিবিআই। সংস্থা সূত্রের খবর, ২০১২ সালের মার্চ মাসে গ্রন্থাগারমন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরী তাঁর দফতরের তত্কালীন সচিব রিনচেং টেম্পো, বিশেষ সচিব রামপদ বিশ্বাস এবং গ্রন্থাগার অধিকর্তা কল্লোল মুখোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠিয়ে ৮টি সংবাদপত্রের নাম লেখা একটি সাদা চিরকুট দেন। তিনি অফিসারদের জানান, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে কেবলমাত্র এই সংবাদপত্রগুলিই রাখতে হবে। সেই মতো নির্দেশ জারি করতে বলেন তিনি। মন্ত্রীর নির্দেশমতো গ্রন্থাগার অধিকর্তা প্রস্তাবটি তৈরি করে বিশেষ সচিবের কাছে পাঠান। বিশেষ সচিব এই প্রস্তাবের উপর সহমত পোষণ করেন এবং একটি খসড়া আদেশনামা তৈরি করে সচিব ও মন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠান। মন্ত্রী অনুমোদন করার পর বিশেষ সচিব আদেশনামাটি বের করেন। ঘটনাচক্রে এখন সেই তিন অফিসারই অবসর নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আব্দুল করিম চৌধুরী বলেন,‘‘এত দিন আগে কী হয়েছিল এখন আর মনে নেই। তবে ফাইলের ব্যাপারে সিবিআই-কে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’’ তবে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, শাসক দলের উপর মহলের নির্দেশেই এমন পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

ফাইল খুঁজে না পাওয়ার পরে সে কথা সিবিআই-কে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় গ্রন্থাগার দফতর। একই সঙ্গে ফাইলের ফটো কপি থাকার কথাও জানানো হয়। সরকারি সূত্রের খবর, সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে তখন ওই ফাইলের প্রত্যয়িত নকল চেয়ে পাঠানো হয়। গ্রন্থাগার দফতরের সচিব বিবেক কুমার নকল দস্তাবেজ ‘অথেনটিকেট’ করার ভার দেন যুগ্মসচিব নারায়ণ সরকারকে। গত মঙ্গলবার নারায়ণবাবু দস্তাবেজ অথেনটিকেট করে সিবিআইয়ের কাছে পাঠান। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা তা গ্রহণ করেনি। কেন?

সংস্থা সূত্রে বলা হচ্ছে, আসল ফাইলের সমস্ত দস্তাবেজই ফটো কপি করে রাখা হয়েছিল কি না, এবং প্রত্যয়িত নকলে দেওয়া হয়েছিল কি না, তা প্রমাণ সাপেক্ষ। তা ছাড়া, আদালতে পেশ করার মতো উপযুক্ত নথি গ্রন্থাগার দফতর পাঠায়নি। ফলে তা ফেরত পাঠানো হয়েছে।

সিবিআইয়ের এক সূত্র জানাচ্ছে, সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফলে গ্রন্থাগারে বিতর্কিত অর্থলগ্নি সংস্থার কাগজগুলি রাখার ব্যাপারে কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা জানা দরকার। এ সংক্রান্ত ফাইলটির নোটশিট দেখে তা জানা যেত। কিন্তু ফাইলটি হারিয়ে যাওয়ায় রহস্য তৈরি হয়েছে। সেই কারণে প্রয়োজনে সরকারি অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

News Paper Rose Valey Goutam Kundu Library
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE