চিটফান্ড আন্দোলন। বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার এজেন্টদের মিছিল। মঙ্গলবার ধর্মতলা চত্বরে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার এজেন্টদের লম্বা মিছিলে মঙ্গলবার দীর্ঘক্ষণ অচল রইল মহানগরের বড় অংশ। পুলিশের হিসেব বলছে, প্রায় পনেরো-বিশ হাজার বিক্ষোভকারী এ দিন জমায়েত হয়েছিলেন শহরের কেন্দ্রস্থলে। ‘অল বেঙ্গল চিট ফান্ড ডিপোজিটর্স অ্যান্ড এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর ছাতার তলায়। ২০১৩ সালে এই এজেন্টরাই বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। সে দিন বিক্ষোভকারী ছিলেন মেরেকেটে শ’খানেক। প্রশ্ন হল, তিন বছরে তাদের সংখ্যা আড়েবহরে এতটা বাড়ল কী করে?
ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা, এক লগ্নি সংস্থার এজেন্ট নিতাই পুরকায়েত জানাচ্ছেন, সারদা কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনের বিক্ষোভ ছিল অসংগঠিত এবং অরাজনৈতিকও। কিন্তু তার পর থেকে আন্দোলন যেমন সংগঠিত হয়েছে, তেমনই তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। কেন?
কারণ, এই আন্দোলনের সঙ্গে যে বিশাল সংখ্যক মানুষের ‘স্বার্থ’ জড়িয়ে আছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। তথ্য বলছে, বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার দ্বারা প্রতারিত আমানতকারী ও এজেন্টের সংখ্যা আনুমানিক ৯০ লক্ষ। অর্থাৎ, গড়ে প্রত্যেকের পাঁচ সদস্যের পরিবার ধরলে, প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের ভরণপোষণ জড়িয়ে রয়েছে এই ধরনের লগ্নি সংস্থাগুলির সঙ্গে। যে সংখ্যাটা কোনও রাজনৈতিক দলই অস্বীকার করতে পারে না।
বেআইনি লগ্নি সংস্থার ফাঁদে পড়ে টাকা খোয়ানোদের নিয়ে গড়ে ওঠা আর একটি সংগঠন— ‘আমানতকারী ও এজেন্ট সুরক্ষা মঞ্চ’-র পুরোভাগে রয়েছেন বিরোধী রাজনীতির পরিচিত মুখেরাই। কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান, সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী, নকশাল অসীম চট্টোপাধ্যায়রা দোষীদের শাস্তি এবং প্রতারিতদের টাকা ফেরানোর দাবিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটেছেন শহরের পথে। মামলাও করেছেন সুপ্রিম কোর্টে। সেই মামলার জেরেই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
এ দিন মিছিলে নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছে এসইউসি-র রাজ্য কমিটির সদস্য রূপম চৌধুরীকে। যদিও তাঁর দাবি, দলগত ভাবে নয়, এই আন্দোলনে তিনি রয়েছেন ব্যক্তিগত ভাবেই। রূপমবাবুর মতো মিছিলে ছিলেন সদানন্দ বাগল, কার্তিক রায়ের মতো এসইউসি-র পরিচিত মুখেরা। এই সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে এসইউসি-র প্রাক্তন সাংসদ তরুণ মণ্ডল ও প্রাক্তন বিধায়ক তরুণকান্তি নস্করও রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। যদিও এ দিনের মিছিলে তাঁদের দেখা যায়নি। আন্দোলনের চালিকাশক্তি হয়েও তার মানে আড়ালেই থাকতে চান রাজনীতিবিদরা। সুজন চক্রবর্তী যেমন এ দিন বলেন, ‘‘সুরক্ষা মঞ্চের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি ঠিকই। কিন্তু
সেটা রাজনৈতিক পরিচয়ের
কারণে নয়, ব্যক্তিগত ভাবেই। সেটা হওয়া উচিত বলেই মনে করি।’’ আর মঞ্চের নেতা সুবীর দে-র দাবি, ‘‘আমাদের সংগঠনের সাড়ে সাত লক্ষ সদস্য রয়েছে। সব দলের সমর্থকই রয়েছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক রং খোঁজা অর্থহীন।’’
এই আড়ালে থাকার প্রবণতা কেন? রূপমবাবুর কথায়, ‘‘এই আন্দোলনের সঙ্গে বিভিন্ন দল ও মতের লোক রয়েছেন। সেখানে একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা বহন করলে আন্দোলনের ঐক্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।’’ তা ছাড়া, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাটা যে হেতু বিপুল, তাই শাসক দলেরও চেষ্টা থাকে, এই জনস্রোতটা যেন বিরোধীদের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে না যায়। ফলে তাঁদের নিয়ে টানাপড়েন চলতেই থাকে। সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আমানতকারী এবং এজেন্টদের মধ্যে বিক্ষোভের আঁচ পেয়েই তাঁরা কোনও রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াই তাঁদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। তার মধ্যে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূলের
অনেক স্থানীয় নেতাও।’’ নিতাইবাবুই যেমন এলাকায় শাসক দলের হয়ে কাজ করেন। আবার এ দিনের মিছিলেও পা মিলিয়েছেন।
আন্দোলন যদি মিলেমিশে হয়, তা হলে সংগঠনগুলি মিশে যাওয়াই কি যুক্তিযুক্ত নয়? রাজনীতির ফাটলটা স্পষ্ট হয়ে পড়ে এই প্রশ্ন উঠতেই। সুবীরবাবুর অভিযোগ, এসইউসি-র সংগঠন আদতে সরকারকেই সুবিধে করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘এ দিন ওদের মঞ্চ থেকে সরকারের প্রতিই আস্থা প্রকাশ করা হয়েছে। স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে নবান্নে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy