রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই জ্বালানি ভরা হচ্ছে অটোয়। সোদপুর-কামারহাটি এলাকায়। ছবি: সুমন বল্লভ
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের নির্বাচনী কেন্দ্র বেলঘরিয়ায় সিএসটিসি গ্যারাজের মধ্যে এক কোটি টাকা খরচ করে এলপিজি পাম্প স্টেশন বসিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী অশোক রায়চৌধুরী। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে কারবার। ২০ বছরের লিজ। পরিবহণ দফতরকে মাসে ভাড়া বাবদ দিতে হবে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন অনেক আশা করে উদ্বোধন করেছিলেন এই পাম্প স্টেশনটি। প্রথম কয়েক মাস বিক্রি বাড়ল। কিন্তু তার পরেই কারবার মুখ থুবড়ে পড়ল। এমনই পরিস্থিতি যে, ঘর থেকে টাকা বার করে পরিবহণ দফতরকে ভাড়া মেটাতে হচ্ছিল। দিতে হচ্ছিল কর্মীদের মাইনেও। শেষ পর্যন্ত এ বছরের জুন মাসে অশোকবাবু পাম্প বন্ধ করে দিলেন।
তিন মাস পাম্প বন্ধ থাকার পরে ব্যাঙ্কের চাপে কয়েক দিন আগে আবার খুলেছেন। কিন্তু বিক্রি নেই। কেন? অশোকবাবুর কথায়, “চার পাশে যে ভাবে কাটা গ্যাসের বেআইনি ব্যবসা রমরম করে চলছে, তাতে পাম্প থেকে কে গ্যাস কিনবে?” কাটা গ্যাস মানে রান্নার গ্যাস। দাম অনেক কম। ব্যবসা বাঁচাতে এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে অশোকবাবু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও ছুটেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে তাঁকে বলা হয়েছে, যারা কাটা গ্যাসের ব্যবসা করছে, আগে তাদের বিরুদ্ধে থানায় ডায়েরি করে আসুন। তার পরে কথা। অশোকবাবুর কথায়, “কার বিরুদ্ধে ডায়েরি করব? এরা তো সব শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় কারবার করছে। অতীতে একাধিক বার পুলিশকে বলেও কোনও লাভ হয়নি। ডায়েরি করার পরে কে আমায় নিরাপত্তা দেবে?”
বিটি রোডের দু’পাশ ধরে ব্যারাকপুর পর্যন্ত, সোদপুর থেকে বারাসত, গড়িয়া থেকে সোনারপুর, বজবজ থেকে বেহালা, হাওড়ার বালি-শ্রীরামপুর থেকে শিবপুর বৃহত্তর কলকাতার সর্বত্র অটো এলপিজি-র এটাই করুণ কাহিনি। এক বছর আগে পর্যাপ্ত এলপিজি স্টেশনের দাবিতে অটোচালকেরা রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতেন। আর এখন বহু অটোচালকই পাম্পমুখো হন না। কলকাতা পুলিশ এলাকায় কাটা গ্যাসের এই সিন্ডিকেটের ‘দাপট’ তুলনায় কিছুটা কম হলেও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে তাদের বদান্যতাতেই অটো চলছে।
বরাহনগর সিঁথি মোড়ে সরকারি সংস্থা বিপিসিএল-এর অটো এলপিজি স্টেশন তিন মাস বন্ধ। কেন? পাম্পের ম্যানেজার জানান, কাটা গ্যাসের দাপটে অটো এলপিজি-র বিক্রি নেই। সরকারি স্তরে বহু বার চিঠি লিখেও কোনও লাভ হয়নি। বিপিসিএলের অটো এলপিজি-র মার্কেটিংয়ের দায়িত্বে থাকা এন সি বেহেরার কথায়, “গ্যাসের অভাব নেই। কিন্তু বিক্রি কমেছে প্রায় ৩০%।” তাঁর অভিযোগ, “রান্নার গ্যাস ঘুর পথে চলে যাচ্ছে কাটা গ্যাসের সিন্ডিকেটের হাতে। সরকারি স্তরে অভিযোগ জানিয়েও ফল হয়নি।”
ভর্তুকির রান্নার গ্যাস অটোতে ভরলে দাম পড়ে কেজিতে ৩০ টাকা। আর বর্তমানে অটো এলপিজি-র দাম কেজির হিসেবে ৮৫ টাকা। প্রতিটি রুটে কিন্তু অটোর ভাড়া ধরা হয় অটো-এলপিজির হিসেবে।
অটো এলপিজি-র সবচেয়ে বড় বিক্রেতা ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন সম্প্রতি কামারহাটিতে নতুন স্টেশন স্থাপন করেও উদ্বোধন করছে না। আইওসি-র এক অফিসারের কথায়, “পাম্পে এলপিজি বিক্রির গ্যারান্টি কোথায়?” আইওসি-র কল্যাণী, বারাসত, বসিরহাট, হুগলি, সাজিরহাট, হাওড়া কেন্দ্রে বিক্রি ক্রমেই কমছে। বৃহত্তর কলকাতায় আইওসি-র ১৭টি এলপিজি পাম্প স্টেশনের মধ্যে ১২টিতে বিক্রি কমেছে। আর এক বেসরকারি গ্যাস সংস্থার হাওড়া এবং ব্যারাকপুরের এলপিজি পাম্প প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। রাস্তায় সব অটো সবুজ রঙে এলপিজি লিখে দৌড়লেও পাম্প স্টেশনগুলি লোকসানের মুখে।
কেবল তেল সংস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এই অবৈধ ব্যবসার ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে রাজ্য সরকারও। ২০১৩-র তুলনায় ২০১৪-য় আইওসি, এইচপিসিএল, বিপিসিএল তিন রাষ্টায়ত্ত সংস্থার কম বিক্রির জন্য ভ্যাট বাবদ রাজ্যের আয় কমেছে ৪ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। এক্সাইজ ডিউটি কমেছে ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া সেস বাবদ আয় কমেছে ৪০ লক্ষ টাকা। বেসরকারি সংস্থার হিসেব ধরলে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকার বেশি। কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, যে কারণে এলপিজি অটো চালু করা হয়েছিল, সেই বায়ু দূষণ রোধের চেষ্টাও কার্যত ব্যর্থ। বাতাসে হাইড্রো-কার্বনের মাত্রা বাড়ছে।
রান্নার গ্যাসে বিউটেন থাকে ৬০% এবং প্রোপেন থাকে ৪০%। আর অটো এলপিজিতে প্রোপেন ৬০% বিউটেন ৪০%। অটো দূষণ বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্র মোহন ঘোষের মতে, “রান্নার গ্যাসে অটো চালালে হাইড্রো-কার্বন ১২৫০ পিপিএমের কম হবে না। কিন্তু অটো এলপিজি-র দূষণসীমা সর্বোচ্চ ৭৫০ পিপিএম। সার্টিফিকেট পাবে না বলে বেশির ভাগ অটোই আজকাল ধোঁয়া পরীক্ষা করে না।” কেবল তা-ই নয়, গাড়ি চালানোর সময়ে ইঞ্জিনের স্পর্ক থেকে যাতে আগুন না লাগে, তার জন্য অটো এলপিজিই ব্যবহারের নিয়ম। রান্নার গ্যাস থেকে গাড়িতে আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে।
আইওসি-র এলপিজি-র দায়িত্বে থাকা চিফ ম্যানেজার আর এন মৌলিকের মতে, “বৃহত্তর কলকাতা জুড়ে যে ভাবে এই কারবার চলছে, তাতে তেল সংস্থা, পুলিশ, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতর একসঙ্গে অভিযান না করলে এটা বন্ধ হবে না।” এই সিন্ডিকেট বা চক্র যে শাসক তৃণমূলের একাংশের মদতেই চলছে, বিভিন্ন তেল সংস্থার কর্তা থেকে শুরু করে পাম্প মালিক, সকলেই এই অভিযোগ করছেন।
সরকারের কী ভূমিকা? পরিবহণমন্ত্রীর কথায়, “এটা বামফ্রন্ট আমলের পাপ। অটোচালকদের বেআইনি কাজ করার পথ সিপিএমই দেখিয়েছে। অবিলম্বে এই কারবার বন্ধ করতে সরকার ব্যবস্থা নেবে।” মদনবাবুর দাবি, “তৃণমূলের লোকেরা সিন্ডিকেট চালাচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা মিথ্যা।” কিছু ক্ষেত্রে পরিবহণ দফতর ব্যবস্থা নিলেও যে এই বেআইনি কারবার বন্ধ করা যায়নি, মদনবাবু কিন্তু তা-ও স্বীকার করেছেন। রান্নার গ্যাস জরুরি পরিষেবার মধ্যে পড়ে। সেই গ্যাস ঘুর পথে অটোতে চলে যাচ্ছে। তা বন্ধ করতে কী করছেন? খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানান, এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। অটোতে রান্নার গ্যাস বন্ধ করতে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি সপ্তাহে এলপিজি বটলিং প্লান্টকে হিসেব দিতে হবে। হিসেব দিতে হবে রান্নার গ্যাসের ডিলারদেরও। সেই সঙ্গে চলবে পুলিশি অভিযান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy