কার্তিকের দেখা নেই। ময়ূর কেনা হয়ে গিয়েছে গন্ডায় গন্ডায়!
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আকাল। তবু রাজনীতির বাজি মাত করতে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ঘোষণা এবং অনেক ক্ষেত্রে তার ভবন তৈরি হয়ে গিয়েছে জেলায় জেলায়। আর তার জব্বর ধাক্কা এসে পড়ছে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসকদের উপরে। কেমন সেই ধাক্কা?
•ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সপ্তাহে দু’দিন ছুটতে হবে কাকদ্বীপ। এমনই ফরমান।
• আর জি কর হাসপাতালের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অস্থায়ী ডেরা হতে চলেছে এগরা। এমনই ফরমান।
• সপ্তাহে অন্তত দু’দিন এসএসকেএম থেকে পাঁশকুড়া, নীলরতন থেকে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতাল কিংবা বর্ধমান মেডিক্যাল থেকে বিষ্ণুপুরে যেতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। এমনই ফরমান।
ওই সব বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসক এখন যে-সব হাসপাতালে নিযুক্ত, সেখান থেকে বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে যেতে হবে ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের চিকিৎসা কেন্দ্রে। ওই বিশেষজ্ঞদের কেউ হৃদ্রোগের ডাক্তার, কেউ ইউরোলজিস্ট, কেউ বা নেফ্রোলজিস্ট। তাঁদের স্থায়ী ডেরা থেকে বাড়তি ডিউটি দিয়ে এ ভাবে জেলায় জেলায় পাঠানো হচ্ছে কেন? এটা কি কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা?
আসলে জেলায় জেলায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। যে-সব সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ভবন তৈরি হয়ে গিয়েছে, ভোটের আগে সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে যাতে পুরো মাত্রায় আউটডোর বা বহির্বিভাগ চালু করিয়ে দেওয়া যায়, সেই জন্যই স্বাস্থ্য ভবনের এই ফরমান। দুষ্টুরা বলছে, ভোট লুটতে জোড়াতালি দিয়ে ‘মহা-বিশেষজ্ঞ’ হাসপাতালের দরজা খুলে জনতার চোখে ধুলো দেওয়া আর কি!
কেননা পরিকাঠামো না-গড়ে হুটহাট গালভরা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ঘোষণা করে কী করে সেখানে নিত্য পরিষেবা জোগানো যাবে, সেই প্রশ্নের জবাব গভীর জলে। তার থেকেও গভীরতর জলে সেই সব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ, যাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দূরের দূরের জেলার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের বহির্বিভাগে অতিরিক্ত দেওয়া হচ্ছে। এমনই একটি মেডিক্যাল কলেজের উদ্বিগ্ন অধ্যক্ষ জানাচ্ছেন, অনেক আগেই তাঁদের হাসপাতালের সঙ্গে একাধিক হাসপাতালকে যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে রোগী দেখতে যেতে হয় বিশেষজ্ঞদের। ‘‘তার উপরে ওই সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে জেলার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের বহির্বিভাগে যেতে হলে আমরা তাঁদের কাজে লাগাব কখন? ওই সব চিকিৎসক নিয়মিত ক্লাস নেন। ওঁরা দূরের হাসপাতালে যেতে বাধ্য হলে ডাক্তারি পড়ুয়ারাও তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সামাল দেব কী ভাবে,’’ অসহায় জিজ্ঞাসা ওই অধ্যক্ষের।
অন্য কিছু হাসপাতালের সঙ্গে আগে থেকেই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের যুক্ত থাকার কথা যে স্বাস্থ্য ভবনের অজানা, তা-ও নয়। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রেরই খবর, এসএসকেএম হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এম আর বাঙুর এবং শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞেরা যান মেয়ো আর লেডি ডাফরিন হাসপাতালে। আর জি কর থেকে ইন্দিরা মাতৃসদন ও অবিনাশ মাতৃসদনে যেতে হয় বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসকদের।
অবস্থাগতিকে আরও কিছু বোঝা চাপছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ঘাড়ে। কলকাতার এক হাসপাতালের সুপার বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য দফতর কিছু দিন আগেই নির্দেশ জারি করে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে মেডিক্যাল অফিসারদের তুলে জেলায় পাঠাতে শুরু করেছে। ফলে তাঁরা মেডিক্যাল কলেজে যে-সব দায়িত্ব সামলাতেন, সেগুলিও শিক্ষক-চিকিৎসকদের ঘাড়ে এসে পড়েছে। একসঙ্গে তাঁরা এত কিছু সামলাবেন কী ভাবে? এতে তো আখেরে পরিষেবার মান নেমে যাবে।’’ এই উদ্বেগ নিরসন করার মতো সূত্র মিলছে না স্বাস্থ্য ভবনে।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার টিপ্পনী, ‘‘রাজ্য সরকার আউটডোর-পিছু পাঁচ হাজার টাকা এবং যাতায়াতের খরচ দিচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। জেলায় না-গেলে হাসপাতালের কাজের পরে প্রাইভেট চেম্বারে বসলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকেরই আয় হয় ২০-৩০ হাজার টাকা। ফলে টাকার অঙ্কে তাঁদের ৮০-১০০ কিলোমিটার যাতায়াতের ধকলে প্রলেপ লাগানো যাবে না।’’
তথাকথিত সুপার স্পেশ্যালিটির পিছনে ছোটায় মফস্সলের বিভিন্ন স্তরের পুরনো হাসপাতালে রোগীরা কী ভাবে বিপন্ন হচ্ছেন, সেই দিকে আঙুল তুলছে অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিসেস ডক্টরস। তাদের অভিযোগ, স্টেট জেনারেল, জেলা ও মহকুমা স্তরের হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আকাল চলছে। সেখানকার রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না-পাঠিয়ে নতুন সুপার স্পেশ্যালিটিতে পাঠানো হচ্ছে। কেন?
‘‘কিচ্ছু করার নেই। সরকারি চাকরি করলে সরকারের নির্দেশ ও নীতি অনুযায়ী চলতে হবে। যত দিন না আলাদা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হচ্ছে, চেঁচামেচি করে কোনও লাভ হবে না,’’ সাফ জবাব স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy