Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

একশো দিনের কাজে প্রথম, দাবি ঘিরে সংশয়

প্রথম হওয়ার ‘তাগিদে’ ১০০ দিনের কাজের সংজ্ঞাই বদলে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার! এ দিন নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে পঞ্চায়েত মন্ত্রী জানান, ১০০ দিনের কাজে টাকা খরচের নিরিখে প্রথম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

প্রথম হওয়ার ‘তাগিদে’ ১০০ দিনের কাজের সংজ্ঞাই বদলে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার!

এ দিন নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে পঞ্চায়েত মন্ত্রী জানান, ১০০ দিনের কাজে টাকা খরচের নিরিখে প্রথম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। মঙ্গলবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, ‘‘১০০ দিনের কাজে আমরা প্রথম হয়েছি। বাংলার টাকা কেটে নিয়েছিল। তার পরেও দেশের মধ্যে আমরা প্রথম।’’ সুব্রতবাবুর দাবি, ২০১৪-’১৫ অর্থবর্ষে রাজ্য খরচ করেছে ৪০০৯.৭৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি, ১৬ কোটি ৯৯ লক্ষ শ্রমদিবস তৈরি করে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাজ্য। সুব্রতবাবুর দাবি, মঙ্গলবার রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক ভিডিও কনফারেন্সে পশ্চিমবঙ্গের এই সাফল্যের কথা জানিয়েছেন পঞ্চায়েত সচিব। পরে মুখ্যমন্ত্রীও ফেসবুকে সাফল্যের কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রী বা পঞ্চায়েতমন্ত্রী যা-ই দাবি করুন, সরকারি কর্তাদেরই একাংশ তা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য হল, রাজ্যে কত বেশি পরিবারকে, কত বেশি দিন কাজ দেওয়া গেল— তার উপরেই নির্ভর করে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের সাফল্য। কারণ, ওই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রকল্পটি চালু হয়েছিল। অথচ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য বলছে, গত অর্থবর্ষে ওই দু’টি ক্ষেত্রেই অন্য বড় রাজ্যগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৪-’১৫ সালে এই প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, টাকা খরচের হিসেবে গোটা দেশে প্রথম হলেও পরিবার পিছু কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২১তম! এ ব্যাপারে প্রথম মানিক সরকারের ত্রিপুরা। পরিবার পিছু গড়ে ৮৭ দিন কাজ দিয়েছে তারা। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কাজ দিতে পেরেছে গড়ে মাত্র ৩৩ দিন!

রাজ্যের সাফল্যের দাবি কত দূর সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে পঞ্চায়েত দফতরের অন্দরেও। দফতরের একাংশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের মতো আর কোনও রাজ্য ৪০০৯ কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি, ঠিকই। কিন্তু এই বিপুল টাকা খরচ হলেও তা দিয়ে কতখানি সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারি কর্তাদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, সম্পদ সৃষ্টি হল না, অথচ টাকা খরচ হয়ে গেল, এমন হলে তো তাকে অপব্যয়ই বলতে হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্যও সফল হয় না।

রাজ্যের দেওয়া হিসেব কতটা খাঁটি নিয়ে, তা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন প্রশাসনিক মহলের একাংশ। কারণ গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক জানাচ্ছে, ২০১৪-’১৫ সালে এই প্রকল্পে মালপত্র (ইট, বালি, পাথর, সিমেন্ট ইত্যাদি) কিনতে এবং তার আগের বছরের বকেয়া মেটাতেই পশ্চিমবঙ্গ ১০৮৩ কোটি টাকা খরচ করেছে। এর অর্থ, শ্রমিকদের মজুরি বাবদ খরচ হয়েছে ২৭০০ কোটি টাকার মতো। প্রকল্প খরচের বাকিটা গিয়েছে প্রশাসনিক কাজের জন্য। দফতরের এক কর্তা, জানান, ৪০০৯.৭৬ কোটি টাকা খরচ দেখানো হলেও আসলে মজুরি বাবদই খরচ হয়েছে ২৭০০ কোটি টাকা।

পঞ্চায়েত দফতরের অফিসারদের একাংশ এও জানিয়েছেন, গত বছর শ্রমিকদের মজুরি, মালপত্র কেনা এবং প্রশাসনিক খরচ মিলিয়ে যে টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ১৮০৪ কোটি টাকা বকেয়া থেকে গিয়েছে। অথচ সাফল্যের খতিয়ানে এই টাকাকেও যুক্ত করা হয়েছে! বস্তুত, গত সপ্তাহেই বিধানসভায় এই নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীর তরফে জানানো হয়, কাজ করার পরেও মজুরি বাবদ ১৩০০ কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়েছে। অর্থাৎ সেই টাকা লোকে হাতে পাননি। কংগ্রেস নেতা মানস ভুইঁয়ার দাবি, বকেয়া টাকার পরিমাণ আরও বেশি। অঙ্কটা ১৮০০ কোটির কাছাকাছি। কাজ করেও টাকা হাতে না পাওয়ায় যেখানে গ্রামাঞ্চলে ক্ষোভ বাড়ছে, সেখানে সরকারের এই দাবি কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।

পঞ্চায়েত দফতরের কয়েক জন কর্তা অবশ্য পরিবার পিছু কাজ দেওয়ার তত্ত্বকে বিশেষ আমল দিতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি, এ রাজ্য অনেক বেশি মানুষ এই প্রকল্পে কাজ করেন। ফলে প্রতিটি পরিবারকে ১০০ দিন কাজ দেওয়া কার্যত অসম্ভব। এখানে ৫১ লক্ষ পরিবার কাজ পেয়েছে, যা অন্য রাজ্যে হয়নি। সেই কারণেই শ্রমদিবস সৃষ্টিতে এ রাজ্য দ্বিতীয় স্থান অধিকার করছে।

সুব্রতবাবু জানান, কেন্দ্র গত বছর ২০ কোটি শ্রমদিবস তৈরির লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল। কিন্তু সময় মতো টাকা না পাওয়ায় এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার জন্য সেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যায়নি। টাকার অভাবে কাজের ক্ষতি হয়েছে। ২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রায় ২৩ কোটি শ্রমদিবস তৈরির লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে দিল্লি। এত শ্রমদিবস তৈরি করা গেলে ১০০ দিনের কাজে কম পক্ষে ৬০০০ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে দাবি করেন মন্ত্রী।

পঞ্চায়েত মন্ত্রী জানান, গত অর্থবর্ষে এই প্রকল্পে ৮ লক্ষ ৪৭ হাজার শৌচাগার তৈরি করা হয়েছিল। এ বছর ইতিমধ্যেই ৩ লক্ষ ২২ হাজার তৈরি হয়ে গিয়েছে। শৌচাগার তৈরির কাজে নদিয়া জেলা ‘নির্মল গ্রাম’-এর স্বীকৃতি পেরেছে। খুব শীঘ্রই বর্ধমান এবং হুগলিও সেই তকমা পেতে চলেছে। তাঁর দাবি, ১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রের কাছ থেকে চাহিদা মতো টাকা পাওয়া গেলে পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস তৈরি করতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE