Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
মেধাবী ছাত্রের মৃত্যুতে গাফিলতির অভিযোগ

ছাত্রের মৃত্যু: ডাক্তার নয়, মিস্ত্রি হাজির অ্যাম্বুল্যান্সে

আশঙ্কাজনক অবস্থায় অত্যাধুনিক অ্যাম্বুল্যান্সে করে বর্ধমান থেকে কলকাতা আনা হচ্ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক কিশোরকে। সঙ্গে ছিলেন নার্সিংহোমের তরফে এক বড় চিকিৎসকও। তার পরেও পথেই ওই কিশোরের মৃত্যু হওয়ার পরে জানা গেল, চিকিৎসক পরিচয়ে আসা ওই ব্যক্তি আসলে শীতাতপ যন্ত্র সারানোর মিস্ত্রি!

অরিজিৎ দাস। নিজস্ব চিত্র

অরিজিৎ দাস। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ০১:৫৫
Share: Save:

আশঙ্কাজনক অবস্থায় অত্যাধুনিক অ্যাম্বুল্যান্সে করে বর্ধমান থেকে কলকাতা আনা হচ্ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এক কিশোরকে। সঙ্গে ছিলেন নার্সিংহোমের তরফে এক বড় চিকিৎসকও। তার পরেও পথেই ওই কিশোরের মৃত্যু হওয়ার পরে জানা গেল, চিকিৎসক পরিচয়ে আসা ওই ব্যক্তি আসলে শীতাতপ যন্ত্র সারানোর মিস্ত্রি!

বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ব যাদবপুরের এই ঘটনায় পুলিশ জানায়, অ্যাম্বুল্যান্সটি বর্ধমানের অন্নপূর্ণা নার্সিংহোম থেকে ভাড়া করা হয়েছিল, অরিজিৎ দাস নামের এক কিশোরকে কলকাতার বাইপাস-সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালে আনার জন্য। কিশোরের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয়েছেন এসি মিস্ত্রি শেখ সরফরাজউদ্দিন ও অ্যাম্বুল্যান্সের চালক তারাবাবু শাহ। পুলিশ জানিয়েছে, বর্ধমানের নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ ও অন্যদের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতি, নাম ভাঁড়িয়ে প্রতারণা, প্রতারণা, হুমকি এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। নার্সিংহোমের ম্যানেজার রবিউল আলম অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘রোগী আমাদের এখানে এসেছিল। কিন্তু শারীরিক অবস্থা খারাপ দেখে আমরা ‘রেফার’ করে দিই। ওঁরাই অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে নিয়ে গিয়েছেন। আমরা কোনও ব্যবস্থা করে দিইনি। আমাদের কোনও দায় নেই।’’

পুলিশ জানিয়েছে, বীরভূম নলহাটির নসিপুরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অরিজিৎ কয়েক দিন ধরেই জ্বর ও কোমরের ব্যথায় ভুগছিল। বাবা রঞ্জিত দাস পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ায় শরীর খারাপ নিয়েই পরীক্ষা দিচ্ছিল অরিজিৎ। কিন্তু ১৪ মার্চ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর তার জ্বর খুব বেড়ে যায়। পরিজনেরা তাকে রামপুরহাট জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতাল সঙ্গে সঙ্গে অরিজিৎকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘রেফার’ করে দেয়।

অরিজিতের মামা শুভেন্দু মণ্ডল জানান, অরিজিৎকে নলহাটি থেকে যে অ্যাম্বুল্যান্সে করে রামপুরহাট আনা হয়েছিল, তাতে করেই তাঁরা কলকাতার দিকে রওনা দেন। কিন্তু কলকাতায় এলে শুক্রবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে না ভেবে ওই অ্যাম্বুল্যান্সের চালকের কথাতেই তাঁরা বর্ধমানের অন্নপূর্ণা নার্সিংহোমে অরিজিৎকে ভর্তি করান।

এই সেই অ্যাম্বুল্যান্স।

বৃহস্পতিবার দুপুর ২টো নাগাদ অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় অরিজিৎকে কলকাতাতেই নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় তার পরিবার। অভিযোগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই রোগীকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। মামা শুভেন্দু মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করার পরে ওই নার্সিংহোম থেকে বলা হয়, ওর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। কলকাতায় নিয়ে যেতে হলে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে এ রকম অ্যাম্বুলেন্স দরকার। এক জন বড় চিকিৎসকও দেওয়া প্রয়োজন। ওঁরাই ব্যবস্থা করে দেবেন।’’

অভিযোগ, এই ‘ব্যবস্থা’ করতে করতেই বিকেল গড়িয়ে যায়। অরিজিতের পরিবার জানান, তাঁদের নার্সিংহোমের তরফে বলা হয় অ্যাম্বুল্যান্সে সঞ্জয় বিশ্বাস নামের এক জন বড় চিকিৎসক অ্যাম্বুল্যান্সে রয়েছেন! এর বিনিময়ে ১২ হাজার টাকাও নেয় ওই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ।

এর পর আর দেরি না করে ছেলের সঙ্গে আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সে উঠতে যান অরিজিতের বাবা, জেঠু, এক দাদা ও মামা। কিন্তু অভিযোগ, তখন বলা হয়, পরিবারের কেউ অ্যাম্বুল্যান্সে উঠতে পারবেন না। তাঁদের জন্য আলাদা গাড়ি ভাড়া করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অরিজিতের বাবা ও জেঠু এক রকম জোর করেই ওই অ্যাম্বুল্যান্সের সামনের আসনে উঠে বসেন। তবে দাদা এবং মামাকে উঠতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। তাঁরা বাধ্য হয়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে আলাদা গাড়ি ভাড়া করে কলকাতার পথে রওনা দেন।

অরিজিতের পরিবার জানিয়েছে, কলকাতায় আসার পথে এক বার চালক নেমেছিলেন গাড়ি থামিয়ে। কারণ জানতে চাইলে চালক তাঁদের জানান, অরিজিতের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়েছিল। তাই তিনি সেটি চালু করতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে থাকা চিকিৎসক সেটি চালু করতে পারলেন না কেন, প্রশ্ন করলেও সদুত্তর পাননি অরিজিতের বাবা ও জেঠু। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ দক্ষিণ শহরতলিতে বাইপাস-সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালে অরিজিৎকে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানান, পথেই তার মৃত্যু হয়েছে!

আকাশ ভেঙে পড়ে অরিজিতের বাবা ও পরিবারের মাথায়। তাঁরা চেপে ধরেন সঞ্জয় বিশ্বাস নামে ওই চিকিৎসককে। আর তখনই চাপের মুখে তিনি জানান, তিনি আসলে এসি মিস্ত্রি, চিকিৎসক নন। তাঁকে ওই নার্সিংহোম থেকে চিকিৎসক সাজিয়ে জোর করে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তাঁর দাবি ওই নার্সিংহোমের চিকিৎসকদের নির্দেশে তিনি কখনও কখনও রোগীকে অক্সিজেনও দিতেন!

ছেলের এ ভাবে মৃত্যু মানতে পারেননি পরিবারের কেউই। শুক্রবার দুপুরে পূর্ব যাদবপুর থানায় ছেলের দেহ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন অরিজিতের বাবা রঞ্জিত দাস। বললেন, ‘‘এ ভাবে ছেলেকে মরতে হবে ভাবতেও পারিনি! ওর মাকে এখনও জানাতে পারেনি। জানি না গিয়ে কী বলব!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE