Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দুই কমিটির দ্বন্দ্বে বিপন্ন তামাক-সতর্কতা

তামাক নিয়ে সংসদে রিপোর্ট পেশ করেছে দু’টি কমিটি। দু’টিই সরকারি কমিটি। অথচ দুই রিপোর্টের মূল মতামতের পার্থক্য ঘোরতর বিভ্রান্তি তৈরি করেছে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে।

ধূমপান-বিরোধী মিছিলে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং অভিনেত্রী ঋতাভরী চক্রবর্তী। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

ধূমপান-বিরোধী মিছিলে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং অভিনেত্রী ঋতাভরী চক্রবর্তী। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০৪:৪৩
Share: Save:

তামাক নিয়ে সংসদে রিপোর্ট পেশ করেছে দু’টি কমিটি। দু’টিই সরকারি কমিটি। অথচ দুই রিপোর্টের মূল মতামতের পার্থক্য ঘোরতর বিভ্রান্তি তৈরি করেছে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে।

একটি কমিটির রিপোর্ট বলছে, মানুষের শরীর ও পরিবেশ দুইয়েরই ক্ষতি করছে তামাক। তাই সরকারকে সর্বশক্তি দিয়েই এই জোড়া সর্বনাশ ঠেকাতে হবে। আর অন্য কমিটির রিপোর্টের মূল কথা, তামাকের ক্ষতিকর দিক এখনও তেমন ভাবে প্রতিষ্ঠিতই হয়নি। তাই তামাক রুখতে মরিয়া চেষ্টার যুক্তি নেই।

একই সরকারের দু’টি কমিটির রিপোর্ট কী ভাবে এমন আদ্যন্ত পরস্পরবিরোধী হতে পারে, সেই প্রশ্ন উঠছে। তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কে বা কারা কবে এই দ্বন্দ্ব ঘোচাবেন? স্বামী নির্বাচনের পরীক্ষায় রাজকুমারীর তিন প্রশ্নের একটি ছিল, দ্বন্দ্ব হয় কাদের মধ্যে? মুখে কিছু না-বলে হাতের দু’টি আঙুল তুলে ধরেছিলেন কালিদাস (তখনও কবি হননি)। সেই ইঙ্গিতময় জবাব ঠিক কি না, বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল স্বয়ংবর সভার তাবৎ জনতা। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল শুধু রাজকন্যার মুখ। তিনি নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কালিদাসের উত্তর ঠিক। দ্বন্দ্ব হয় দুইয়ের মধ্যে।

কিন্তু একই হাতের দু’টি আঙুলের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় কি না, হলে সেটা হাত বা গোটা শরীরের পক্ষে স্বাস্থ্যকর কি না, রাজকুমারী বা কালিদাস কেউ তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে জানা নেই। সরকারের শরীরের দু’টি আঙুল যদি হয় ওই দু’টি কমিটি, তাদের দুই রিপোর্টের দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে তামাকের বিষ থেকে জনগণকে বাঁচাবে কে?

দু’টি কমিটিই নিজেদের বক্তব্যের পক্ষে নানান যুক্তি খাড়া করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই এ দেশে তামাক শিল্পের লবি প্রভূত শক্তিশালী। এ বার জনপ্রতিনিধিদের একাংশও যদি সরাসরি সেই লবির পাশে দাঁড়ান, তা হলে সেটা হবে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সামিল। মঙ্গলবার, বিশ্ব তামাক-বিরোধী দিবসে সরকারি দুই কমিটির এই পরস্পরবিরোধিতা মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করবে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।

কী রয়েছে ওই দুই রিপোর্টে?

গত মার্চে লোকসভার ‘কমিটি অন সাব-অর্ডিনেট লেজিসলেশন’ জানিয়েছিল, ভারতীয় কোনও গবেষণা এখনও পর্যন্ত নেই, যার সিদ্ধান্ত থেকে জোর দিয়ে বলা যাবে যে, তামাক থেকে ক্যানসার হয়। বরং সন্দেহের জেরে সিগারেটের প্যাকেটের ৮৫ শতাংশ জুড়ে ছবি দিয়ে যদি মানুষকে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা হয়, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। এক দিকে এতে সরকারের আয়ে টান পড়বে। বহু বিক্রেতা রাতারাতি রুজিরোজগার হারাবেন। সেই সঙ্গে বাজারে হুহু করে ঢুকবে নিম্ন মানের বেআইনি বিড়ি-সিগারেট। বিড়ি শিল্প বন্ধ হলে বহু শ্রমিক রাতারাতি কাজ হারাবেন। তাই সে-দিকটিও বিচার্য।

চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞদের দাবি, তামাকের সঙ্গে ক্যানসারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। রাজ্যসভার পরিবেশ সংক্রান্ত একটি কমিটি কয়েক দিন আগে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। সেই রিপোর্টের বক্তব্য, তামাক শিল্প থেকে দেশে যে-পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে যায় তামাকের প্রতিক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়া রোগের চিকিৎসায়। সেই জন্যই তামাক চাষ কমানোর উপরে জোর দিয়েছে ওই কমিটি। তাদের রিপোর্টে এটাও বলা হয়েছে যে, তামাক চাষ অরণ্য ধ্বংস করছে, ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’ বাড়িয়ে ক্ষতি করছে পরিবেশের। তামাকের ব্যবহার রুখতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থ, শিল্প, পরিবেশ, তথ্য-সম্প্রচার এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক যাতে যৌথ ভাবে প্রচারে নামে, সেই সুপারিশ করা হয়েছে ওই রিপোর্টে।

এই দুই পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট সরকারি নীতি নির্ধারকদের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, লোকসভার ‘কমিটি অন সাব-অর্ডিনেট লেজিসলেশন’-এর রিপোর্টটির প্রভাব খুবই ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। এর ফলে সিগারেটের কুফল সম্পর্কে যতটুকু সচেতনতা তৈরি হয়েছিল, তা ফের তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। বাড়বে ফুসফুসের ক্যানসার, মুখ ও গলার ক্যানসার। নিজেদের এই আশঙ্কার কথা লিখিত ভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকশো চিকিৎসক।

এ দেশে যত মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হন, তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশের রোগের জন্য দায়ী তামাক। শুধু তামাকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় প্রতি বছর ১০ লক্ষ ভারতীয়ের মৃত্যু হয়। পূর্বাঞ্চলে ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দু’‌কোটি। এটা প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশেরও বেশি।

এই পরিপ্রেক্ষিতে তামাকের উপরে জোরদার নিয়ন্ত্রণ না-আনলে তা আরও বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে অনেক চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা। তাঁরা বলছেন, দু’টি সরকারি কমিটির রিপোর্টের দ্বন্দ্ব তামাক মোকাবিলার সমস্ত রকম প্রচেষ্টার পথে কাঁটা ছড়িয়ে দিতে পারে। ওই দু’টি পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট যে-বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে, তার জেরে তামাক ব্যবহার নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামতে পৌঁছতে দেরি হবে নীতি নির্ধারকদের। আর নীতি নির্ধারণে সেই বিলম্বের ফল ভুগতে হবে আমজনতাকেই।

এ দেশে ফি-বছর তামাক থেকে ছড়িয়ে পড়া রোগের চিকিৎসায় এক লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়। অন্য দিকে, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করে আয় হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান দিয়ে তামাক-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, মুম্বইয়ের টাটা ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক পঙ্কজ চতুর্বেদী জানান, বিড়ি-সিগারেট তো ক্ষতিকর বটেই। তা ছাড়া সিগারেটের টুকরো থেকেও পরিবেশের নানা ভাবে ক্ষতি হয়ে চলেছে। ‘‘তামাক থেকে মানুষ ও পরিবেশের এই সমূহ সর্বনাশ প্রতিরোধের জন্য উদ্যোগী হতে হবে সরকারকেই,’’ বলছেন চতুর্বেদী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tobacco Conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE