রাজীব গাঁধী চালু করেছিলেন ‘পিএম টু ডিএম’ নীতি। উদ্দেশ্য ছিল, কেন্দ্রের টাকা রাজ্যকে এড়িয়ে সরাসরি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দু’দশক বাদে পূর্বসূরির পথে আর এক ধাপ এগিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চালু করেছেন ‘পিএম টু পিপ্ল’ নীতি। উদ্দেশ্য: রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি বা একশো দিনের কাজের মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা একেবারে উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পোঁছে দেওয়া।
সেই মতো পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। বিরোধিতার ধারাবাহিকতাও বহাল। রাজীবের আমলে দিল্লির নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বাম জমানার সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকারও মোদী-নীতির বিরোধিতার পথে হাঁটতে চলেছে। রাজ্যের প্রতিবাদ এ ক্ষেত্রে মূলত একশো দিনের কাজকে ঘিরে।
দিল্লির ‘পিএম টু পিপ্ল’ নীতি কাগজে-কলমে বলবৎ হয়ে গিয়েছে গত ১ এপ্রিল। তাতে বলে দেওয়া হয়েছে, এ বার থেকে একশো দিনের কাজের মজুরি সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে পাঠানো হবে। কী ভাবে?
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানান, এত দিন এই প্রকল্পের টাকা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘স্টেট এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি ফান্ড’-এ জমা পড়ত। নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী মজুরি প্রদান, সরঞ্জাম খরিদ ও প্রশাসনিক খরচ মেটাতে রাজ্য সরকার তা ব্যয় করত। ওই সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ হতে চলেছে। এমনকী, গ্যারান্টি ফান্ড নামক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে। পরিবর্তে একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা সরাসরি উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। তার উপরে কার্যত রাজ্যের কোনও হাত থাকবে না।
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে রাজ্য পঞ্চায়েত দফতরের এক কর্তা জানান, একশো দিনের কাজ প্রকল্পে তিন ভাবে খরচ ধরা হয়। ১) মাটি কাটার মজুরি ২) রাস্তা-বাঁধ নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদির জন্য সরঞ্জাম কেনার খরচ ও দক্ষ শ্রমিকদের মজুরি এবং ৩) প্রশাসনিক খরচ। এর মধ্যে সিংহভাগ টাকা যায় মাটি কাটার মজুরি খাতে। ‘‘কেন্দ্রের পাঠানো টাকার কতটা বছরের কোন সময়ে, কোন খাতে খরচ হবে, এ যাবৎ রাজ্য সরকার তা ঠিক করত। নতুন ব্যবস্থায় সে ক্ষমতা থাকছে না।’’— বলেন কর্তাটি।
অর্থাৎ, প্রকল্পের গাইডলাইন মেনেই প্রতিটি ভাগের টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খরচ করতে হবে। নিজের ইচ্ছেমতো তা বেশি বা কম করা যাবে না।
এবং দিল্লির এই নতুন নিয়ম দেখেই প্রমাদ গুনছেন নবান্নের কর্তারা। এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘গত অর্থবর্ষে (২০১৪-১৫) একশো দিনের কাজে পশ্চিমবঙ্গের খরচ হয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। তার ১৮৩০ কোটি টাকার মজুরি এখনও মেটানো যায়নি।’’ কেন যায়নি?
কর্তাটির ব্যাখ্যা: গত অর্থবর্ষে প্রশাসনিক খরচ মেটাতে ও সরঞ্জাম কিনতে মজুরি খাতের টাকা অনেকটা বেরিয়ে গিয়েছে। তাই অত টাকার মজুরি বাকি। ‘‘উপরন্তু যে পরিমাণ কাজ হয়েছে, কেন্দ্র তার টাকাও দেয়নি।’’— মন্তব্য তাঁর। পঞ্চায়েত দফতর-সূত্রের খবর: একশো দিনের কাজে মোট প্রকল্প-বরাদ্দের মধ্যে যে হেতু মজুরির টাকার অঙ্ক বেশি, তাই অন্য খাতে অর্থের দরকার পড়লে তাতেই হাত পড়ে। ফলে সাময়িক ভাবে কিছু মজুরি বকেয়া থেকে যায়। পরে দিল্লি থেকে ফের টাকা এলে তার একটা অংশ দিয়ে পাওনা মজুরি মেটানো হয়। বাকি টাকায় অন্যান্য কাজ চলে।
এ ভাবেই দীর্ঘ দিন চলে আসছে। এখন মর্জিমাফিক খরচের এক্তিয়ার হাতছাড়া হতে বসেছে দেখে কর্তাদের মাথায় হাত। যার জেরে ‘বিদ্রোহের’ সুর শোনা যাচ্ছে দফতরের অন্দরে। কী রকম?
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় দিল্লির ফরমান অগ্রাহ্য করার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘‘মুখে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলা হচ্ছে! অথচ বাস্তবে দিল্লি চাইছে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিজের হাতে নিতে।’’ রাজ্যের আপত্তির কথা জানিয়ে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন সচিবকে ইতিমধ্যে চিঠি পাঠিয়েছেন। পঞ্চায়েতের এক কর্তার বক্তব্য, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম কিস্তি বাবদ দিল্লি ইতিমধ্যে ১৮৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেও পশ্চিমবঙ্গে একশো দিনের কাজ ঘোর অনিশ্চিত। কারণ, এই টাকায় মজুরির বকেয়া মেটালে চলতি বছরে কাউকে নতুন কাজ দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি প্রকল্পে যুক্ত কর্মচারীদের বেতনও বন্ধ হয়ে যাবে বলে তাঁর আশঙ্কা।
এ হেন নানা যুক্তি দেখিয়ে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে আপত্তি ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। নবান্ন চাইছে, কেন্দ্রের টাকা
প্রথমে পঞ্চায়েত দফতরে আসুক। দফতরই ঠিক করবে, কী ভাবে উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তা পাঠানো হবে। দিল্লি অবশ্য এতে রাজি নয়।
‘‘অন্য রাজ্য ব্যবস্থাটি মেনে নিতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি কেন?’’— প্রশ্ন তুলেছেন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এক কর্তা। ওঁদের হুঁশিয়ারি— পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন নিয়মটি মেনে না-নিলে এ রাজ্যে গোটা প্রকল্প অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কারণ, নিয়ম না-মানলে দিল্লি টাকা পাঠাবে না।
এমন একটা নিয়ম চালু করার পিছনে কারণ কী?
দিল্লির দাবি, একশো দিনের কাজ নিয়ে অভিযোগ ভুরি ভুরি। যার অন্যতম, ভুয়ো মাস্টাররোল তৈরি করে মজুরির টাকার অপব্যবহার। ‘‘ভুয়ো মাস্টাররোল যদি না-থাকে, এক খাতের টাকা যদি অন্য খাতে না-যায়, তা হলে এই ব্যবস্থায় কোনও রাজ্যের আপত্তি থাকার কথা নয়।’’— পর্যবেক্ষণ এক কেন্দ্রীয় কর্তার। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘রান্নার গ্যাস বা রেশনের ভর্তুকির টাকা সরাসরি উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যেতে পারলে একশো দিনের কাজের মজুরির টাকা কী দোষ করল?’’
নবান্নের তরফে এর পাল্টা কোনও স্পষ্ট যুক্তি মিলছে না। পঞ্চায়েত দফতরের একটাই দাবি— পুরনো ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু নতুন নিয়ম না-মানলে যদি দিল্লির টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়, যদি বকেয়া মেটাতে গিয়ে নতুন কাজ শুরুই করা না যায়, তা হলে কী হবে?
নবান্ন নিরুত্তর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy