Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রেশন-বিক্ষোভে বোমা, রায়নায় হত সিপিএম কর্মী

কোনও মিটিং-মিছিল নয়। হয়নি বিক্ষোভও। ছিল খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে ব্লক অফিসে স্মারকলিপি দেওয়ার নেহাতই ‘নিরীহ’ কর্মসূচি। সিপিএমের সেই কর্মসূচিতেই বোমাবাজি করার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বোমার ঘায়ে মারা গেলেন এক সিপিএম কর্মী।

স্বপন মালিকের মৃতদেহের পাশে অমল হালদার। — নিজস্ব চিত্র।

স্বপন মালিকের মৃতদেহের পাশে অমল হালদার। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রায়না শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৭
Share: Save:

কোনও মিটিং-মিছিল নয়। হয়নি বিক্ষোভও। ছিল খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে ব্লক অফিসে স্মারকলিপি দেওয়ার নেহাতই ‘নিরীহ’ কর্মসূচি। সিপিএমের সেই কর্মসূচিতেই বোমাবাজি করার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বোমার ঘায়ে মারা গেলেন এক সিপিএম কর্মী।

ঘটনাস্থল, বর্ধমানের রায়না ১ ব্লকের শ্যামসুন্দর। সিপিএমের অভিযোগ, স্মারকলিপি দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় তাদের কর্মী-সমর্থকদের উপরে স্থানীয় শ্যামসুন্দর কলেজের ছাত্রাবাসের ছাদ থেকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মীরা বোমা ছোড়েন। তাতে ১৯ জন কর্মী জখম হন। গুরুতর জখম অবস্থায় চার জনকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মারা যান স্বপন মালিক (৫০)। বাড়ি রায়নার উচিতপুর গ্রামে। রায়না থানায় ওই কলেজের ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সম্পাদক সৌমেন মাইতি-সহ ১১ জনের নামে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা বোমার ভয়ে পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ। অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের পাল্টা দাবি, স্মারকলিপি দিতে আসার নাম করে সিপিএম শ্যামসুন্দর কলেজের ছাত্রাবাসে ঢুকে টিএমসিপি কর্মীদের মারধর করেছে। এলাকার বাজারে বেছে বেছে তৃণমূল কর্মীদের দোকান ভাঙচুরও করেছে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য কৃষক সভার সম্পাদক তথা বর্ধমান জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অমল হালদারের নেতৃত্বে রায়না থানায় বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম। অমলবাবুর অভিযোগ, বিধানসভা ভোটের মুখে শিল্পায়ন থেকে শুরু করে খাদ্য সুরক্ষা ও ডিজিটাল রেশন কার্ড সংক্রান্ত বিভ্রান্তি নিয়ে যে ভাবে বামেরা পথে নেমেছেন, তাতে ভয় পেয়েছে শাসকদল। সেই ভয় থেকেই এ দিন স্মারকলিপির মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বোমা নিয়ে হামলা চালিয়েছে তৃণমূলের দু্ষ্কৃতীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বৈধ খাদ্যশস্য তো পেলেনই না, উপরন্তু স্বপন মালিক তৃণমূলের সমাজবিরোধীদের ছোড়া বোমায় প্রাণ হারালেন। তাঁর রক্ত বৃথা যাবে না! সংগ্রাম তীব্রতর হবে।’’ হামলার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার শ্যামসুন্দর-সহ বর্ধমান জেলা জুড়ে মিছিল করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সিপিএম।

সম্প্রতি জাঠা কর্মসূচির সময় বিভিন্ন জেলায় বাম নেতা-কর্মীদের উপরে হামলার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বাম সাংসদ থেকে বিধায়ক, জোনাল সম্পাদক থেকে নিচুতলার কর্মী— মারের হাত থেকে রেহাই পাননি কেউই। শেষ পর্যন্ত রাশ টানেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম-জাঠায় হামলা যাতে না হয়, দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যেই সে বার্তা দেন মমতা। তাতে পরিস্থিতি বদলায়। শিল্পায়নের দাবিতে বামেদের সিঙ্গুর থেকে শালবনি বিশাল পদযাত্রার সময় শাসকদলের তরফে সে ভাবে বাধা দেওয়ার ছবি দেখা যায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম বর্ধমানেরই কেতুগ্রাম। সেখানে মহম্মদ সেলিমের সভায় হামলা হয়েছিল।

সেই বর্ধমানেরই রায়নায় এ দিনের ঘটনার পরে সিপিএমের অভিযোগ, ভোট যত এগোবে, ততই হামলা বাড়বে। বিশেষ করে তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্ভাব্য জোট নিয়ে যখন শাসকদলে যথেষ্টই কাঁপুনি ধরেছে!

কী হয়েছিল শ্যামসুন্দরে?

রেশন-বিভ্রান্তি নিয়ে সারা রাজ্যেই এ দিন স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ছিল সিপিএমের। শ্যামসুন্দরে রায়না ১ ব্লক অফিসে এ দিন বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ স্মারকলিপি দিতে যান কয়েক হাজার দলীয় কর্মী-সমর্থক। তাঁদের অভিযোগ, যাওয়ার সময়ই কয়েকশো মিটার দূরে দূরে বোমাবাজি করা হচ্ছিল। পুলিশকে সে কথা বলা হলেও তারা কান দেয়নি। ৫টা নাগাদ ফেরার পথে সরাসরি হামলা হয়। সিপিএম কর্মী বিষ্ণু সাঁতরা ও অশোক ঘোষ বলেন, ‘‘কলেজ হস্টেলের ছাদেই লুকিয়ে ছিল তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। সেখান থেকে আমাদের মিছিলে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা ছুড়তে থাকে। আমাদের অনেকে জখম হন। স্বপনদাও হাতে বোমা লেগে রাস্তায় পড়ে যান। তাঁর পিঠেও বোমা পড়ে। সেই অবস্থাতেই তৃণমূলের লোক ওঁকে লাঠিপেটা করে!’’ ওই কর্মসূচিতে সামিল সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তথা জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি উদয় সরকারের অভিযোগ, ‘‘পুলিশ বোমাবাজির মুখে ছুটে পালায়!’’

স্বপনবাবু-সহ তিন জন আহত শ্যামসুন্দর কলেজের গায়ে পিচ রাস্তার উপর প্রায় আধ ঘণ্টা পড়েছিলেন। পরে থানায় সিপিএম বিক্ষোভ জানানোর পরে পুলিশ তাঁদের তুলে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। পথেই মারা যান পেশায় খেতমজুর স্বপনবাবু। তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা তাদের দু’টি বাস ও ৮টি ট্রেকারে ভাঙচুর চালিয়েছে বলেও অভিযোগ সিপিএমের। অভিযোগ মানেননি বর্ধমানের এসপি কুণাল অগ্রবাল। তাঁর দাবি, পুলিশ ছিল বলে গণ্ডগোল আরও বড় আকার নেয়নি। ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।

তৃণমূলের তরফে বর্ধমানের পর্যবেক্ষক তথা আবাসন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ঘটনাটি এড়িয়ে বলেছেন, ‘‘যা বলার বর্ধমান জেলার সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথ বলবেন।’’ স্বপনবাবুর দাবি, এই ঘটনার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্কই নেই! জেলা তৃণমূলের নেতা উত্তম সেনগুপ্তের অভিযোগ, ‘‘সিপিএমের হামলায় আমাদেরই বেশ কয়েক জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শ্যামসুন্দর কলেজের এক ছাত্রীকে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়েছে। আমরাও থানায় অভিযোগ জানাচ্ছি।”

শ্যামসুন্দর কলেজের অধ্যক্ষ গৌরীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কলেজ চত্বরে কোনও ঘটনা ঘটেনি। ছাত্রাবাসের ব্যাপারে আমার কাছে কোনও খবর আসেনি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE