Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

কারাটের সামনেই জোটের পক্ষে দু’হাত তুলল রাজ্য সিপিএম

পক্ষে ৪৩, বিপক্ষে ১১! সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাটদের উপস্থিতিতে আলিমুদ্দিনের লড়াইয়ে জয়ী হলেন জোটপন্থীরাই। তৃণমূলের মোকাবিলায় কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে বৃহত্তর জোট গড়ে তোলা প্রয়োজন— সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই মতই গৃহীত হল সিপিএম রাজ্য কমিটিতে। এ বার এই প্রস্তাব যাচ্ছে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য। আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে আর এক প্রস্ত লড়াই!

রাজ্য কমিটির বৈঠকে সূর্যকান্ত মিশ্র, সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাট। আলিমুদ্দিনে শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

রাজ্য কমিটির বৈঠকে সূর্যকান্ত মিশ্র, সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাট। আলিমুদ্দিনে শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

প্রসূন আচার্য ও সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২৮
Share: Save:

পক্ষে ৪৩, বিপক্ষে ১১!

সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাটদের উপস্থিতিতে আলিমুদ্দিনের লড়াইয়ে জয়ী হলেন জোটপন্থীরাই। তৃণমূলের মোকাবিলায় কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে বৃহত্তর জোট গড়ে তোলা প্রয়োজন— সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই মতই গৃহীত হল সিপিএম রাজ্য কমিটিতে। এ বার এই প্রস্তাব যাচ্ছে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য। আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে আর এক প্রস্ত লড়াই!

রাজ্য কমিটি যে জোটের পক্ষে সওয়াল করবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। জেলায় জেলায় দলের নিচুতলার মনোভাব এই মুহূর্তে ঠিক কেমন, কারাটদের তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এ বার একটু অন্য রকম কৌশল নিয়েছিল বঙ্গ ব্রিগেড। জেলা ধরে ধরে প্রতিনিধিদের বলতে দেওয়ার প্রথা বদলে ব্যক্তি হিসেবে বক্তা রাখা হয়েছিল। রাজ্য কমিটির মধ্যে যাঁরা জোট-প্রশ্নে মুখ খুলতে চেয়েছেন, তাঁদের নাম রাখা হয়েছিল বক্তা তালিকায়। দলের রাজ্য নেতৃত্ব যে জোট চান, সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই স্পষ্ট ছিল। সেই সঙ্কেত পড়ে নিয়েই শুক্রবার রাজ্য কমিটির প্রথম দিনে ৫৪ জন বক্তার সিংহভাগ শুধু জোটের পক্ষে সওয়ালই করলেন না! তত্ত্ব আঁকড়ে থাকায় তুলোধোনাও করলেন কারাট শিবিরকে!

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নেতা শমীক লাহিড়ী যেমন বৈঠকে মন্তব্য করলেন, সিপিএম এর মধ্যে অনেক বার আত্মহত্যা করেছে। দয়া করে আর যেন আত্মহত্যা করতে যাওয়া না হয়! উত্তর ২৪ পরগনার নেপালদেব ভট্টাচার্যের শ্লেষ, প্রথমেই তিনি কারাটকে অভিনন্দন জানাতে চান! কারণ কলকাতায় প্লেনামে এসে কারাট সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। এই অবস্থার মোকাবিলা বাংলায় বামেদের করতে হবে। যাঁরা একটু বই-টই কম পড়েন, তাঁরা ওই কথা থেকেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। মুর্শিদাবাদের মইনুল হাসান আরও এক ধাপ এগিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘শাস্ত্রে’র চেয়ে ‘সত্য’ বড়! বাংলায় সত্য বলছে, তৃণমূলকে হারাতে মতপার্থক্য ভুলে একজোট হতে হবে।

এমন সওয়ালের মুখবন্ধ বেঁধে দিয়েছিলেন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রই। বৈঠকের গোড়াতেই এ দিন তিনি স্পষ্ট করে দেন, পার্টি কংগ্রেসের কৌশলগত লাইনই শুধু মেনে চললে তাঁরা কংগ্রেস-প্রশ্নে সরাসরি ‘না’ বলে দিতেন! কিন্তু সেই পার্টি কংগ্রেসের দলিলেই ‘নমনীয়’ কৌশলের কথাও উল্লেখ ছিল। যা রাজ্যওয়াড়ি পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরজা খুলে রেখেছে। এবং পশ্চিমবঙ্গে এখন যা পরিস্থিতি, তার বিচার করেই তাঁরা বৃহত্তর জোটের পক্ষে সওয়াল করছেন। তৃণমূলকে পরাস্ত করতে দলের নিচু তলায় এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ভাবে বিরোধী ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছে, তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না— এ বার কারাটের সামনেও সেই যুক্তির পুনরাবৃত্তি করেছেন সূর্যবাবু। যে কথা তিনি বলেছিলেন কয়েক দিন আগে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিকে নিয়ে নির্বাচনী কর্মশালায়।

জরুরি অবস্থার চেয়েও পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক পরিবেশের হাল এখন খারাপ, এই অভিযোগ করতে গিয়ে এ দিনের বৈঠকে মুগবেড়িয়া ও সুনিয়ার সাম্প্রতিক দুই ঘটনার উদাহরণ টেনেছেন রাজ্য সম্পাদক। মুগবেড়িয়ায় স্বয়ং সূর্যবাবুর সভার মাঠে জল ঢেলে সমাবেশ বানচাল করার চেষ্টা হয়েছিল। আর সুনিয়ায় রবীন দেব, তাপস সিংহ, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিছিলের সময়ে আশপাশ থেকে শূন্যে গুলি চালানো হয়েছিল। এক দিকে এমন পরিবেশ এবং অন্য দিকে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৃণমূলের মেরুকরণের চেষ্টা— এমন পরিস্থিতি ভারতের আর কোথাও এখন নেই বলে সওয়াল করেন সূর্যবাবু।

তবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় জোট করার ব্যাপারে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্যের যে সায় ছিল না, তা-ও জানিয়ে দেন সূর্যবাবু। তার সূত্র ধরেই রাজ্য কমিটির সদস্য প্রণব চট্টোপাধ্যায় সওয়াল করেন, তার মানে তো বোঝাই যাচ্ছে এই বিষয়ে ঐকমত্য নেই! আবার কলকাতার নেতা কল্লোল মজুমদার প্রশ্ন তোলেন, আরও আগেই কেন রাজ্য কমিটির বৈঠক ডেকে বিষয়টি স্পষ্ট করে নেওয়া হল না? যদিও কলকাতারই আর এক নেতা মানব মুখোপাধ্যায় আবার পাল্টা বলেন, মানুষের চাহিদা এখন মাথায় রাখতে হবে। মানুষ কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়ার কথাই বলছে। বর্ধমানের অমল হালদার, অচিন্ত্য মল্লিক, জলপাইগুড়ির সলিল আচার্য, মুর্শিদাবাদের মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যেরা দলের রাজনৈতিক লাইনের প্রশ্ন তুলেই কংগ্রেস-বিরোধিতায় সরব হয়েছেন। অমলবাবু অবশ্য উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, কোনও একটি বৈঠকে উপস্থিত ২২ জনের কাছে তিনি জোট-প্রশ্নে মত চেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২০ জনই পক্ষে মত দিয়েছিলেন! তবে তাঁদের কিছু সংশয়ও ছিল! তাঁর ওই উদাহরণ থেকেই মইনুলেরা পাল্টা সওয়াল করেন কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পক্ষে।

হাওড়ার জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদারের আপত্তি আবার আরও তাত্ত্বিক প্রশ্নে! তিনি জানান, কোনও একটি কর্মসূচিতে বিডিও-র কাছে দাবিপত্র দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে বিডিও নাকি তাঁকে বলেন, সিপিএম দলটা কি ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ পার্টি হয়ে গেল? দলের চেয়েও সংবাদমাধ্যম বেশি করে জোট চাপিয়ে দিচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। যার জবাবে উত্তর ২৪ পরগনার পলাশ দাস, সায়নদীপ মিত্রেরা বলেন, যে চাহিদার কোনও ভিত্তি নেই, তাকে জোর করে চাপানো যায় না! মানুষের মধ্যে জোটের চাহিদা আছে বলেই এত লেখালেখি হচ্ছে। হুগলির জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর প্রশ্ন, বামরা কি আগে কখনও কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি? তা হলে এখন এত কথা কেন? ঋতব্রত বলেন, অতীতে অনেক বার সিপিএম ‘বাস মিস’ করেছে! এখন সময় এসেছে মানুষের চাহিদার সঙ্গে দলের তাত্ত্বিক অবস্থান মিলিয়ে নেওয়ার।

দিনভর আলোচনার শেষে পলিটব্যুরোর সদস্য বিমান বসু রাজ্য কমিটির সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, এ ভাবে এক দিনে ৫৪ জনের খোলাখুলি মতামত দেওয়ার নজির তাঁর স্মরণে নেই! ‘গণতান্ত্রিক’ আবহেই জোটের সওয়াল করে প্রথম রাউন্ডের পরে কারাট শিবিরকে প্রবল চাপে রাখল বাংলা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE