মিষ্টি ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে পুরপ্রধান। —নিজস্ব চিত্র।
খাঁটি ঘি দিয়ে প্রথমে ভেজে নিতে হয় ক্ষীর মেশানো চালের গুঁড়ো আর ময়দা মাখা। লাল টকটকে হয়ে গেলে তার ভিতরে সযত্নে কুলুঙ্গিতে সন্দেশ রাখার মতো করে রেখে দিতে হয় ক্ষীরেরই পুর। তারপরে তা ফেলা হত রসে। বাড়িতে জামাই এলে তার পাতে পড়ত এই মিষ্টি। নাম ছিল জামাই আদর।
বিয়ের পর প্রথমবার জামাই বাড়ি এলে তার জন্য এই মিষ্টি রান্নাঘরেই বানিয়ে নিতেন শাশুড়ি, শ্যালিকারা। সেই জামাইও নেই। সেই জামাই আদরও নেই। উবে গিয়েছে আস্ত মিষ্টিটাও। ‘জামাই আদর’ বলতে এখন আর কেউ কোনও মিষ্টির নাম বোঝেন না। শোনা যায়, জানবাজারের রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে দুই বড় বাক্স সন্দেশ নিয়ে যেতেন। এক বাক্স ভবতারিণীর জন্য, অন্যটি শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য। সেই মানের সন্দেশও এখন অমিল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অনেক।
মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, দেশি মিষ্টির জায়গা নিচ্ছে ভিন রাজ্যের মিষ্টি। পান্তুয়া মেলে কম। কিন্তু গুলাব জামুনের বাজার চড়া। ক্ষীর দিয়ে তৈরি এবং ঘিয়ে ভেজে গরম রসে ফেলে তৈরি গুলাবজামুনকে দেখে ‘জামাই আদর’-এর কথা মনে পড়ে যায়। এসেছে কাজু বরফি এবং শোনপাপড়িও।
এই সব প্রসঙ্গই উঠে এল শুক্রবার জলপাইগুড়ির রবীন্দ্র ভবনে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের জেলা সম্মেলনে। জলপাইগুড়ি জেলায় মিষ্টির দোকান প্রচুর হলেও সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৬০ জন। উত্তরবঙ্গে সংগঠনের সভ্য সংখ্যা ৪০০ জন। এসেছিলেন কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। ছিলেন রাজ্য মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রবীন পাল এবং উত্তরবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সঞ্জীব বণিক। তাঁদের দাবি, কারিগরদের প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের তরফেও ব্যবস্থা করা দরকার।
তাঁদের আলোচনায় উঠে এল প্রধানত চারটি দিক।
এক, পুরনো মিষ্টি ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই রেসিপি সংগ্রহ করতে হবে। কারিগরকে সেই মতো শিক্ষা দিতে হবে। তা হলে মিষ্টির বাজারে আবার বাঙালির রসনা হারিয়ে যাওয়া স্বাদ ফিরে পাবে। কিন্তু তাতে সমস্যা হল ভাল কারিগরের অভাব। যেমন, একসময় জলপাইগুড়ির সেরা মিষ্টি ছিল বাদামবরফি। একটি পরিবার এবং তার আত্মীয় স্বজনরা এই মিষ্টি বানাতেন। তাদের কারিগররা মারা যাওয়ার পর জলপাইগুড়ির সেই বাদাম বরফিও হারিয়ে গেছে। জলপাইগুড়ি মিষ্টি ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বাবু ঘোষ বলেন, “ভাল কারিগর না থাকলে গুণমানের মিষ্টি তৈরি হতে পারবে না।’’
দুই, বিখ্যাত যে সব মিষ্টি এখনও বানানো হচ্ছে, সেগুলি রক্ষা করতে হবে। যেমন কোচবিহারের প্রাণহরা, মালদার রসকদম্ব, গঙ্গারামপুরের দৈ এবং ফুলবাড়ির পান্তুয়া। সেক্ষেত্রেও আশঙ্কার কথা সম্মেলনে উঠে এল যে, নতুন প্রজন্মের কারিগরেরা আর মিষ্টি তৈরিতে আগ্রহী নয়। তাই সে দিকেও নজর দিতে হবে।
তিন, তৈরি করতে হবে নতুন মিষ্টি। বাবু ঘোষ যেমন বলেন, ‘‘আমরা এখন মোহন ক্ষীর নামে একটা মিষ্টি তৈরি শুরু করেছি।”
চার, ঘরে ঘরে এখন মধুমেহ বা ডায়াবেটিসের প্রকোপ। সেই রোগীদের কথা মাথায় রেখে মিষ্টি বানাতে হবে। রাজ্য মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রবীন পাল বলেন, “এখন আমরা আমাদের সদস্যদের বেশি করে ডায়াবেটিক রোগীরা খেতে পারেন এমন মিষ্টি তৈরি করতে বলেছি। এছাড়া কিছু হার্বাল মিষ্টিও তৈরি হচ্ছে। কলকাতায় এগুলো চালু হলেও অন্য জেলায় এগুলো চালু করার আমরা চেষ্টা করছি।” ইতিমধ্যে কোচবিহারের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের তাঁরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, আইআইটি এবং ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ কেমিক্যাল স্টাডিজের সহযোগিতায় হার্বাল মিষ্টি তৈরি হচ্ছে।
সম্মেলনে এসে অনেক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী জানতে পারলেন, এসে গিয়েছে মিষ্টি তৈরির মেশিনও। সেখানে রসগোল্লা, সন্দেশ এবং পুর দেওয়া মিষ্টি যন্ত্রই তৈরি করে ফলছে। প্রথম পাকটি বার হওয়ার পর কড়াইয়ে দিয়ে দিলেই মিষ্টি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। জলপাইগুড়ি মিষ্টি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক পরিতোষ মল্লিক বলেন, “জলপাইগুড়িতে এগুলোর সঙ্গে আমরা একেবারেই পরিচিত ছিলাম না। সম্মেলন হওয়ার জন্য এগুলো আমরা জানতে পারছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy