Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

থালা বিলিয়ে পুকুর চুরি ডিজিটাল ইন্ডিয়ার

থিকথিকে ভিড় ঠেলে হাসি মুখে বেরিয়ে আসছিলেন তাজামুল শেখ আর তাঁর স্ত্রী সাকিলা। হাতে চকচক করছে স্টেনলেস স্টিলের থালা।‘‘আজ্ঞে, আমরা লিখতে-পড়তে জানি না। কম্পিউটারের সামনে আধ ঘণ্টা বসতে হল। ব্যস, দু’জনকেই একটা করে থালা দিয়ে বলল, বাড়ি যাও’’— হাসি আর ধরে না ফরাক্কার শিবনগরের বাসিন্দা তাজামুলের।

থালা হাতে এক ‘পড়ুয়া’। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

থালা হাতে এক ‘পড়ুয়া’। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

বিমান হাজরা
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

থিকথিকে ভিড় ঠেলে হাসি মুখে বেরিয়ে আসছিলেন তাজামুল শেখ আর তাঁর স্ত্রী সাকিলা। হাতে চকচক করছে স্টেনলেস স্টিলের থালা।

‘‘আজ্ঞে, আমরা লিখতে-পড়তে জানি না। কম্পিউটারের সামনে আধ ঘণ্টা বসতে হল। ব্যস, দু’জনকেই একটা করে থালা দিয়ে বলল, বাড়ি যাও’’— হাসি আর ধরে না ফরাক্কার শিবনগরের বাসিন্দা তাজামুলের।

মাউস কী জানেন? কি বোর্ড?

প্রশ্ন শুনে হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন দু’জনেই।

তাঁরা যখন ফিরে যাচ্ছেন, তখনও অর্জুনপুরের ওই কম্পিউটার সেন্টার়ে উপচে পড়ছে ভিড়। ওঁরা সকলেই আর কিছু ক্ষণের মধ্যে সরকারের খাতায় ‘কম্পিউটার-শিক্ষিত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। থালা হাতে বাড়ি ফিরবেন। ফিনফিনে সেই থালার দাম মেরে-কেটে ১৭ টাকা।

আর তাঁদের ‘কম্পিউটার শিক্ষা’ দেওয়ার দৌলতে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা পকেটে পুরবে কম্পিউটার সেন্টার। সময় আর বেশি নেই। ৩১ অগস্ট নাম লেখানোর শেষ দিন। সকলেরই তাই খুব তাড়াহুড়ো।

প্রতি ঘরে এক জনকে কম্পিউটার শেখানোর জন্য বছরখানেক আগে চালু হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের ‘ন্যাশানাল ডিজিট্যাল লিটারেসি মিশন’ (এনডিএলএম) প্রকল্প। তার জন্য সরকারি তথ্যমিত্র কেন্দ্রের সংখ্যা যথেষ্ট না হওয়ায় বেশ কিছু বেসরকারি ‘এজেন্সি’কে নিয়োগ করা হয়েছিল। এ রাজ্যে যেমন হাজার দুয়েক তথ্যমিত্র কেন্দ্রের পাশপাশি ১২৩টি এজেন্সি দায়িত্ব পায়। তারা হাজার ছয়েক বেসরকারি কম্পিউটার সেন্টারকে নিয়োগ করে। পুকুর চুরিতে নেমেছে তেমনই কিছু সেন্টার।

রাজ্যে এই প্রকল্পের আধিকারিক অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বলছেন, “ভুয়ো নামে রেজিষ্ট্রি করে লক্ষ-লক্ষ টাকা জালিয়াতি হয়েছে। মালদহ ও বর্ধমানে অন্তত ২৩টি সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদেও বেশ কিছু সংস্থার নামে অভিযোগ রয়েছে।”

চুরির পরিমাণটা কিন্তু নগণ্য নয়। অরূপবাবুর হিসেবে, ‘‘রাজ্যে অন্তত ৫৬০০ সেন্টার চলছে। দেখা যাচ্ছে, সেগুলিতে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ৫ লক্ষ ৭০ হাজার পরিবারের মানুষ কম্পিউটার শিখে গেছেন। বাস্তবে যা অসম্ভব!’’ কী ভাবে হচ্ছে চুরি?

নিয়ম হল, এই প্রকল্পে কম্পিউটার শেখার জন্য কেউ নাম লেখালে তাঁকে টানা ২০ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর পরে কম্পিউটারের ওয়েবক্যামের সামনে বসে তাঁকে অনলাইনে ৬০ মিনিটে ২০টি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অনলাইনে চলে আসবে শংসাপত্র। আর কম্পিউটার সেন্টারের মালিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে যাবে টাকা— তফসিলি জাতি-জনজাতি ও দারিদ্রসীমার নীচে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা এবং অন্যদের ক্ষেত্রে ৩৭৫ টাকা। এবং বহু জায়গায় কাউকে কিছু না শিখিয়ে পরীক্ষার দিন ওয়েবক্যামের সামনে বসিয়ে রেখে উত্তর দিচ্ছেন সেন্টারের লোকেরা। তার পরে হাতে থালা-বাটি ধরিয়ে টাকা হাতাচ্ছেন।

শিবনগরের তাজামুলের মতোই থালা পেয়েছেন স্থানীয় ভ্যানরিকশা চালক পেন্টু শেখ ও তাঁর স্ত্রী বিড়ি শ্রমিক রাসেদা বিবি, অর্জুনপুরের বিড়ি শ্রমিক তাঞ্জেরা বিবি, দিনমজুর শরিফ শেখ, দিয়াড়াপাড়ার রাবি খাতুনেরা। সকলেই নিরক্ষর। চিন্তিত মুখে তাঞ্জেরা বলেন, “সেন্টার মালিক বলেছে, মাসে মাসে আমার নামে ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকবে। আমার তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই!” হরিপুরের রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের বাড়ির পাঁচ জনই এখন ‘ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া’র সদস্য। কেউই জীবনে মাউস স্পর্শ করেননি।

রোজই অর্জুনপুর, সুতির মধুপুর বা অরঙ্গাবাদে কিছু কম্পিউটারের দোকানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভিড়। কে কত লোক টানতে পারে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গিয়েছে। অর্জুনপুরের একটি সেন্টারে দু’মাসে ৯৯৯১ জনের নাম রেজিষ্ট্রি হয়েছে। কাশিমনগরে ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। মধুপুরে এবং হিজলতলায় ১১ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।

সুতির একটি সেন্টারের মালিক মহম্মদ ইমরান আলির কথায় কোনও লুকোছাপা নেই, “ব্যবসা করতে গেলে কিছু উপহার তো দিতেই হয়।’’ সকলেই অবশ্য কম্পিউটার শিক্ষার বদলে থালাবাটি দিয়ে টাকা হাতানোর কথা কবুল করছেন না। ফরাক্কার এক সেন্টারের মালিক সহিদুল ইসলাম যেমন দাবি করেন, “আমি এ পর্যন্ত ৫২০০ জনের পরীক্ষা নিয়েছি। এখন তারা কম্পিউটার না চালাতে পারলে কী করব? তিন মাস আগে দিব্যি পেরেছে। এখন হয়তো ভুলে গেছে!”

সরকারি তথ্যমিত্র কেন্দ্রগুলির ছবি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। সমশেরগঞ্জের চাঁদপুরে মোতাহার আলির তথ্যমিত্র কেন্দ্রে যেমন গত মাত্র ২১৪ জনের নাম দু’মাসে নথিভুক্ত হয়েছে। পরীক্ষা দিয়েছেন মোটে ১২ জন। অরূপবাবুর আক্ষেপ, “আমরা পুরোনো তথ্যমিত্র কেন্দ্রগুলিকে দিয়েই এ কাজ করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার বাইরে বহু সেন্টারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেই ফাঁক দিয়েই পুকুর চুরি হচ্ছে।’’এ বার কী হবে? তদন্ত হবে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে— বলছেন অরূপবাবুরা। তা নয় হল? ঘরে ঘরে ‘ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া’র দীপ জ্বালানোর কী হবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Digital India Pond
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE