জেলাশাসকের দফতর থেকে বেরিয়ে আসছেন মা-মেয়ে। ছবি: সুদীপ ঘোষ
গায়ে রং-বেরঙের ছাপ দেওয়া জামা। ডান হাত দিয়ে মায়ের হাতের দু’টো আঙুল শক্ত করে ধরা। আর বাবার ছবি বেরোনো সোমবারের খবরের কাগজটা (আনন্দবাজার পত্রিকা) ধরা বাঁ হাতে।
সোমবার দুপুরে বারাসতে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসকের দফতরে মা-কে নিয়ে ঢুকল ন’বছরের ঋতরাজ্ঞী বর্মন। বেলঘরিয়ার আদর্শনগরে যাদের বাড়িতে গত শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তাণ্ডব চালায় ডাকাতেরা। ঋতরাজ্ঞীর বাবা, তিন মাস আগে প্রয়াত রাজীব বর্মন ছিলেন এই দফতরের নির্বাচন বিভাগের কর্মী। সব জানার পর জেলাশাসক মনমীত নন্দা নিজেই দেখা করতে চেয়েছিলেন ঋতরাজ্ঞীর সঙ্গে।
জেলাশাসক দেখা করতে চেয়েছেন শুনে এ দিন মেয়েকে নিয়ে যান গীতা বর্মন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি, রাজীবের মা উমা দেবীও। বেলা দেড়টা নাগাদ তাঁরা জেলাশাসকের ঘরে ঢোকেন। গীতা সবে বলছিলেন, ‘‘আসলে ম্যাডাম, মেয়েটাকে মানুষ করার জন্য আমার একটা কাজ খুব দরকার। আপনি যদি...।’’ তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়েই জেলাশাসক মনমীত ছোট্ট ঋতরাজ্ঞীকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, ‘‘ও তো আমারও মেয়ে। আমিই না হয় ভাবব ওর পড়াশুনো আর বড় হওয়া নিয়ে। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না।’’ ঋতরাজ্ঞীর হাতে একটা চকোলেটের প্যাকেট আর রঙ পেনসিলের বাক্স দিয়ে মনমীত প্রশ্ন করেন, ‘‘তুমি কী খেতে সব চেয়ে বেশি ভালবাস?’’ ঋতরাজ্ঞীর মায়ের চোখে তখন জল টলটল করছে! স্বামীর সহকর্মীরা তাঁকে কেউ দিদি, কেউ বোন বলে সম্বোধন করেছেন। আতিথেয়তার কোনও খামতি রাখেননি জেলাশাসকের দফতরে।
রাজীবের চাকরিটা তাঁর স্ত্রী পেতে পারেন কি না, জেলাশাসকের সঙ্গে বর্মন পরিবারের সাক্ষাৎকারে সেই প্রসঙ্গ উঠেছে। গীতাদেবীর সামনেই জেলাশাসক তাঁর দফতরের আধিকারিক ও কর্মীদের কাছে খোঁজ নেন, রাজীববাবুর ফাইলটি কী অবস্থায় আছে। প্রশাসন সূত্রের খবর, গীতা বর্মনকে চাকরির ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে। নিজের দফতরের আধিকারিক-কর্মীদেরও বিষয়টি সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখার কথা বলেছেন জেলাশাসক। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, রাজীবের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর স্ত্রীর চাকরি পাওয়ার বিষয়টি সহজ ছিল না। সরকার এ ক্ষেত্রে এক লপ্তে থোক কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়। আবার কেউই চাকরি পান না, তা-ও নয়। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এই ডাকাতির ঘটনা এবং ঋতরাজ্ঞীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি বর্মন পরিবারের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম করে দিয়েছে। চাকরির ব্যাপারে আশ্বাসের পাশাপাশি রাজীবের পেনশন দ্রুত চালু করার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন জেলাশাসক।
রাজীববাবুর মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত তাঁর মা, কর্পোরেশন স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা উমা বর্মনের পেনশনের সাত হাজার টাকাই ছিল পরিবারটির সম্বল। শুক্রবার রাতে ডাকাতেরা উমা দেবীর দু’মাসের পেনশনের টাকা লুঠ করে নিয়ে যায়। গয়নাগাটি যেটুকু ছিল, বাদ যায়নি তাও। এমনকী ঋতরাজ্ঞীরা আঙুলের ঝুটো আংটিও রেহাই পায়নি তাদের থাবা থেকে। বৃদ্ধার মাথায় পাইপগান ঠেকানো থেকে কচি মেয়ের গলায় ভোজালি ধরা, সবই মুখ বুজে দেখতে হয়েছে ওঁদের। ডাকাতেরা টেবিলের উপরে রাখা রাজীবের ছবিটা টান মেরে নীচে ফেলে। ঋতরাজ্ঞীকে চড় মেরে তার মুখে বালিশ চেপে ধরে। ঋতরাজ্ঞীর ‘দোষ’, সে বলেছিল, ‘‘আমার বাবা থাকলে এমন করতে পারতে না!’’
খবরের কাগজে এই ঘটনার কথা পড়ে এবং ঋতরাজ্ঞীর মানসিক অবস্থার কথা জেনে সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে চেয়েছেন অনেকেই। ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক পীযূষ গোস্বামীও তদ্বির করেছেন গীতাদেবীর চাকরি নিয়ে। পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন নদিয়ার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ও। শুধু সরকারি অফিসার ও কর্মীরাই নন, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ, বহু সংস্থাও ওই পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। সকলেরই প্রার্থনা, ঋতরাজ্ঞী যাতে সুস্থ জীবনে ব়ড় হতে পারে।
তবে বর্মন পরিবার এখনও আদর্শনগরের বাড়িতে ফিরতে ভরসা পাচ্ছে না। ডাকাতদের সাত জন ধরা পড়েছে বলে পুলিশ দাবি করার পরেও না। তাঁরা ঋতরাজ্ঞীর মাসির বাড়িতেই আছেন। ঠাকুমা উমাদেবী এ দিন বলেন, ‘‘এত মানুষ যোগাযোগ করছেন, বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিচ্ছেন! বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। আমার বৌমাই সব সামাল দিচ্ছে।’’
ঋতরাজ্ঞীকেও এ দিন যখনই কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে, সে একটাই জবাব দিয়েছে, ‘‘মাকে জিজ্ঞেস করো।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy