Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘শবর-জননী’র অন্তিম কাজ করবেন শবররাও

সুঠাম বিরাট একটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে ডালপালা মেলে। অনেকটা দূর থেকে দেখা যায়। সেই গাছের গায়েই পরম যত্নে হাত বোলাতে বোলাতে আশিস সিংহ দেও বললেন, ‘‘এর নীচেই বসে থাকতেন আমাদের দিদি।’’

এখানে বসেই শবরকন্যাদের ঘরকন্নার খবর নিতেন মহাশ্বেতা দেবী। পুরুলিয়ার রাজনওয়াগড়ে প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।

এখানে বসেই শবরকন্যাদের ঘরকন্নার খবর নিতেন মহাশ্বেতা দেবী। পুরুলিয়ার রাজনওয়াগড়ে প্রদীপ মাহাতোর তোলা ছবি।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ০৩:০৫
Share: Save:

সুঠাম বিরাট একটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে ডালপালা মেলে। অনেকটা দূর থেকে দেখা যায়। সেই গাছের গায়েই পরম যত্নে হাত বোলাতে বোলাতে আশিস সিংহ দেও বললেন, ‘‘এর নীচেই বসে থাকতেন আমাদের দিদি।’’

পুরুলিয়া রাজনওয়াগড়ে ওই গোপীধ্বজ গাছটির সামনে একটি চেয়ার পেতে বসে থাকতেন মহাশ্বেতাদেবী। মোড়া টেনে বসতে বলতেন অন্যদের। শবর রমণীদের ঘরকন্নার কথা শুনতেন। ছোটখাট সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতেন। এই তল্লাটের মানুষ সাহিত্যিক মহাশ্বেতার বদলে সমাজসেবী মহাশ্বেতাকেই বেশি চিনতেন। কারও দিদি, কারও কাছে মা-ও। তাঁর মৃত্যুতে তাই নিকটজনকে হারানোর শোকে ভাসছেন তাঁরা।

সম্পর্ক তো সেই কবে থেকে। ১৯৮৩-র নভেম্বরে পুরুলিয়া জেলার ১৬৪টি গ্রাম ও টোলার শবরদের একজোট করতে পুরুলিয়া ১ ব্লকের মালডি গ্রামে শবর উন্নয়ন সমিতির প্রাণপুরুষ পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরপুরুষ গোপীবল্লভ সিংহ দেও ‘শবর মেলা’র আয়োজন করেছিলেন। তখন থেকেই শবরদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য উদ্যোগী হন মহাশ্বেতা। এই মেলার মঞ্চ থেকেই এক ছাতার তলায় চলে আসে বিনপুরের লোধা শবর সমিতি ও পুরুলিয়ার শবর উন্নয়ন সমিতি। নাম হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া-শবর কল্যাণ সমিতি’। কার্যকরী সভাপতি হন মহাশ্বেতা। রাজনওয়াগড়ে তৈরি হয় তাদের দফতর। সেই ভবনেরই পরে নাম হয় মহাশ্বেতা ভবন। তারই সামনে ওই গোপীধ্বজ বৃক্ষ। ম্যাগসাইসাই পাওয়ার পরে ১০ লক্ষ টাকা এই সমিতিকেই দান করে দিয়েছিলেন মহাশ্বেতা।

প্রবীণ ও অসুস্থ গোপীবল্লভবাবুকে এখনও মহাশ্বেতার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়নি। তাঁর ভাইপো আশিসবাবু জানালেন, প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সময় পেলেই এখানে চলে আসতেন মহাশ্বেতা। ‘অপরাধ প্রবণ জনজাতি’ তকমাটা শবরদের উপর থেকে তুলে ফেলতে কলম তো ধরেইছিলেন, তাঁদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। সাধারণত থাকতেন রাজনওয়াগড়ে। পুরুলিয়া স্টেশনে সকালে ট্রেন থেকে নেমেই ‘ভাই’ বলে তাঁদের হাসিমুখে জড়িয়ে ধরতেন। তারপর পরিচিত সকলের খবর নিতেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। গ্রামের সকলেই স্কুলে যাচ্ছে কি না, সবাই বইপত্র পেয়েছে কি না— সব জানতে চাইতেন। সেখান থেকেই সঙ্গীদের নিয়ে কেন্দা থানার অকড়বাইদ, মানবাজারের জনাড়া, বরাবাজারের কুদা, বোরোর তিলাবনির মতো শবরদের গ্রামে গিয়েছেন বারবার। নদী দেখলে জলে নেমে পড়তেন। কখনও সারা দিন সেই ভেজা শাড়ি পরেই কাটিয়ে দিতেন। শবরদের বাড়িতেই খেতেন। কেউ নেশা করছে শুনলে তাঁকে বকাঝকাও করতেন। রোগ হলে হাসপাতালে নিয়ে না গেলেও তাঁর মুখ রাগে থমথমে হয়ে যেত।

শবরদের জন্য তাঁর আইনি লড়াইয়ের তালিকায় মাইলফলক হয়ে রয়েছে ডাকাতির অভিযোগে ধৃত কেন্দা থানার অকড়বাইদ গ্রামের বুধন শবরকে পুলিশের পিটিয়ে মারার অভিযোগ নিয়ে মামলাটি। এ ছাড়া শবরদের উন্নয়নে রাজ্য সরকারের বরাদ্দ অর্থের সদ্ব্যবহার নিয়েও তিনি হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। ছাগল চুরির অভিযোগে তিলাবনি গ্রামের ললিত শবরের কব্জি থেকে কেটে নেওয়া হয়েছিল। কলকাতায় তাঁর চিকিৎসার জন্য মহাশ্বেতা সে দিন কী করেছিলেন তা এখনও এলাকার মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। কুদা গ্রামে শবর-খেড়িয়া কল্যাণ সমিতির সম্পাদক জলধর শবর তাই বলছেন, ‘‘ভাবতেই পারছি না মা আর নেই।’’

শুক্রবার কলকাতায় যখন তাঁর শেষকৃত্য হচ্ছে, কুদা গ্রামের চাকা নদীর ধারের শ্মশানে শবররা পুঁতলেন একটা সেগুন গাছ। জলধর বললেন, ‘‘যত ঝড় জল হোক, জানতাম বিরাট একটি বৃক্ষের মতো আমাদের আড়াল করে রাখবেন তিনি। তাঁকে টলানো যেত না।’’ তাই ‘শবর-জননী’ বলেই চিনতেন তাঁকে মানুষ।

জলধরই জানালেন, দশ দিন পরে নিজেদের নিয়ম মতোই মহাশ্বেতার অন্তিম কাজ করবেন শবরেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mahasweta Devi Purulia Social activist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE