Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
’১৬-র বিধানসভা নির্বাচন

বুথ ছাড়িয়ে সুরক্ষা দিক আধাসেনা, চায় কমিশন

খাস কলকাতার ‘অভিজাত’ উপনগরী, যেখানে কিনা আইন-পুলিশ-প্রশাসনের বহু তাবড় কর্তার বাস। সেই সল্টলেকেরই মামুলি পুরভোটে সন্ত্রাস যদি এমন লাগামছাড়া চেহারা নিতে পারে, তা হলে বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যের জেলায়-জেলায় কী হবে?

এ ভাবেই পুলিশের সামনে হুমকি চলেছিল সল্টলেকে।—নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই পুলিশের সামনে হুমকি চলেছিল সল্টলেকে।—নিজস্ব চিত্র।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪২
Share: Save:

খাস কলকাতার ‘অভিজাত’ উপনগরী, যেখানে কিনা আইন-পুলিশ-প্রশাসনের বহু তাবড় কর্তার বাস। সেই সল্টলেকেরই মামুলি পুরভোটে সন্ত্রাস যদি এমন লাগামছাড়া চেহারা নিতে পারে, তা হলে বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যের জেলায়-জেলায় কী হবে?

বিধাননগর, ও পাশাপাশি আসানসোলে সদ্যসমাপ্ত পুরভোটে ‘গা-জোয়ারি’র বহর দেখে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অন্দরে এখন এই প্রশ্নটা প্রকট হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। কমিশন মনে করছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় বেশ কিছু ভোট ঘিরে গণ্ডগোল হলেও সাম্প্রতিক পুরভোট ইদানীংকালের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। পুর-পঞ্চায়েত ভোটে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কোনও ভূমিকা না-থাকলেও বিধানসভা (বা লোকসভা) ভোট পরিচালনার মূল দায়িত্ব তাদেরই। সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সন্ত্রাস-পরিস্থিতির মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চাইছে উদ্বিগ্ন কমিশন।

এবং তাদের ভাবনায় ‘প্রয়োজনীয়’ পদক্ষেপগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল, ভোটের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত সংখ্যক আধাফৌজ মোতায়েন। শুধু মোতায়েনই নয়, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঠিকঠাক কাজে লাগিয়ে নাগরিকদের অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করার দিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। ‘‘জওয়ানদের স্রেফ বুথের সামনে দাঁড় করিয়ে না-রেখে আশপাশেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। যাতে কোনও ভোটার বুথ পর্যন্ত পৌঁছাতে বাধা না-পান।’’— পর্যবেক্ষণ এক আধিকারিকের।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৬-র মে মাসের মধ্যে। আগামী বছর অসম, তামিলনাড়ু, কেরল, মেঘালয়েও ভোট রয়েছে। এই সব ভোট একসঙ্গে হবে কিনা, এখনও ঠিক হয়নি। তবে কমিশনের মাথারা এক বাক্যে বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। তাই ভোট যখনই হোক, এখানে যথেষ্ট আধাফৌজ পাঠানোয় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে এক প্রস্ত আলোচনা সেরে রেখেছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী। কমিশনের তরফে মন্ত্রকে চিঠিও (ডিও নম্বর: ইসি-২৩৪৭-১২/এ ২০১৫) গিয়েছে।

বস্তুত পর্যাপ্ত আধাফৌজ জোগানের স্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গ-অসমে একটি পর্বে ও অন্যত্র আর এক দফায় ভোট আয়োজনের একটা সম্ভাবনা থাকছে বলে সূত্রের ইঙ্গিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অবশ্য কমিশনকে আশ্বস্ত করে বলেছে, একসঙ্গে ভোট হলেও বাহিনী কম পড়বে না। জৈদী জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ-সহ যে সব রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন, সেখানে ভোটার তালিকা সংশোধন শুরু হয়ে গিয়েছে। এ বার রাজ্যগুলির আইন-শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে কমিশনের বৈঠক হবে। ‘‘রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভাবে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটদানের পরিবেশ গড়ে তোলাটাই আমাদের কাছে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ।’’— বলেছেন জৈদী।

বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির জল ঘোলা হওয়ারও প্রভূত সম্ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরভোটের আগেই দিল্লি এসে ‘অগণতান্ত্রিক ভাবে’ রাজ্যের এক্তিয়ারে নাক গলানোর অভিযোগ তুলে গিয়েছেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, পুরভোটে আধাসেনা চেয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী নবান্নকে না-জানিয়ে সরাসরি দিল্লিতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বেশ কিছু রিপোর্টও তিনি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে। এ হেন প্রেক্ষাপটে দিল্লির দরবারে তৃণমূলনেত্রীর অভিযোগ, রাজ্যপাল ‘কেন্দ্রের এজেন্ট’ হিসেবে, ও রাজ্য বিজেপি নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে চলছেন।

তবে ঘটনা হল, বিধানসভা ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ামাত্র সংবিধান মোতাবেক রাজ্যের প্রশাসন চলে যাবে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজে কমিশনের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে রাজ্যের তিন ডিভিশনাল কমিশনারকে— জলপাইগুড়ি রেঞ্জের বরুণকুমার রায়, প্রেসিডেন্সি রেঞ্জের নন্দিনী চক্রবর্তী ও বর্ধমান রেঞ্জের হরি রামুলু। ভোটপর্ব না-মেটা পর্যন্ত এঁরা নির্বাচন কমিশনের আমলা হিসেবে গণ্য হবেন। ভোটের পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে অফিসার বদলির ক্ষমতাও কমিশনের বিলক্ষণ রয়েছে। এর সুবাদে ভোটের বিহারে বেশ কিছু প্রশাসনিক রদবদলও করেছে কমিশন। প্রচুর আধাসেনা মোতায়েনের পাশাপাশি সরানো হয়েছে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব-সহ প্রায় দু’ডজন অফিসারকে, যাঁদের অনেকে নীতীশ-লালুর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত।

কমিশনের এ হেন সক্রিয়তা দেখে প্রমাদ গুনছেন বাংলার শাসক নেতৃত্ব। মমতার দাবি, কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে দিয়ে বিজেপি বিহারের ভোট নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। ‘‘বাংলায় ওরা এই খেলা খেলতে গেলে কঠিন মূল্য দিতে হবে।’’— আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য: পশ্চিমবঙ্গ অন্য ধরনের রাজ্য। এখানকার মানুষের স্বাজাত্যবোধ খুব তীব্র।

দুই শহরের পুরভোটে বল্গাহীন দুষ্কৃতী তাণ্ডবের সুবাদে সেই ‘ব্যতিক্রমী’ রাজ্যই তামাম দেশের নজর কেড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শাসকের বেড়ি হাতে পড়ে রাজ্যের পুলিশ পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখে গিয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন কিন্তু বিধাননগর-আসানসোলে আধাফৌজ চেয়েছিল। অন্য দিকে নবান্ন দাবি করেছিল, রাজ্যের পুলিশ দিয়েই পুরভোট সামাল দেওয়া যাবে। শেষমেশ আধাফৌজ ছাড়াই পুরভোট হয়েছে।

কিন্তু বিধানসভা ভোটে আধা ফৌজ তো থাকবেই, বাহিনীর সংখ্যায় যাতে টান না-পড়ে, কমিশন সেটাও নিশ্চিত করে ফেলতে চাইছে। চাহিদামতো আধাসেনা না-পাওয়ার জন্য অতীতে একাধিক বার কমিশনের তরফে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দিকে আঙুল উঠেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র-সচিব রাজীব মহর্ষির বক্তব্য, ‘‘চাহিদা-জোগানের সমস্যা রয়েছে। শুধু তো ভোট নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলার স্বার্থে আধাসেনা দরকার।’’ আধা সামরিক বাহিনীর বহর বাড়াতে চেয়ে তাঁরা ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রকে দরবার করেছেন বলে জানিয়েছেন মহর্ষি।

কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেই কি সব মুশকিল আসান?

এমনটা অবশ্য মোটেও নয়। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারে। তাই রাজ্যকে এড়িয়ে একতরফা বাহিনী মোতায়েন অসম্ভব। বস্তুত কত জওয়ানকে কোন বুথে, কোন রাস্তায় রাখা হবে, এ সব সিদ্ধান্ত রাজ্য প্রশাসনই নিয়ে থাকে। ‘‘আধাসেনা জেলার রাস্তাঘাটও চেনে না। এ জন্য তাদের সংশ্লিষ্ট রাজ্য প্রশাসনের উপরে নির্ভর করতেই হয়।’’— মন্তব্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র-সচিবের। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠালেই ভোট শান্তিতে হবে, এটা ভাবা উচিত নয়।’’

উপরন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীকে শুধু বুথের বাইরে বসিয়ে রাখলে মূল উদ্দেশ্যটাই মাঠে মারা যায় বলে কমিশনের অভিমত। কর্তারা জানিয়েছেন, বহু জায়গায় দেখা গিয়েছে, প্রতিপক্ষের ভোটারদের শাসানি দিয়ে বাড়ি থেকেই বার হতে দেওয়া হয়নি। কিংবা বেরোলেও তাঁরা বুথে এসে উঠতে পারেননি, কারণ বুথের চারপাশের এলাকা ঘিরে রেখেছিল দুষ্কৃতীরা। এই জাতীয় অভিযোগ শাসকদলের বিরুদ্ধেই বেশি ওঠে, যেমন উঠত বাম জমানার পশ্চিমবঙ্গে। বিরোধী ভোট রোখার একই দাওয়াই তৃণমূল আমলেও দস্তুরমতো চালু রয়েছে বলে অভিযোগ।

এমতাবস্থায় কমিশনের অন্দরের অভিমত, আধাফৌজকে বুথের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো তল্লাট জুড়ে কাজে লাগানো জরুরি। গোয়েন্দা-তথ্যের ভিত্তিতে স্পর্শকাতর এলাকায় ফ্ল্যাগ মার্চ বা টহলদারি শুরু করতে হবে ভোটের ক’দিন আগে। ‘‘এতে ভীতির পরিবেশ অনেকটা ঘুচবে।’’— মন্তব্য এক অফিসারের।

সূত্রের খবর, কমিশনের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বৈঠকে এই বিষয়টিও উঠবে। এই সব ‘কঠোর’ ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে মতানৈক্য হলেও আলাপ-আলোচনায় তা মিটিয়ে নেওয়া যাবে বলে কমিশন আশাবাদী। নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ ঘিরে দু’পক্ষের বিতণ্ডা নতুন কিছু নয়। বিগত লোকসভা ভোটের মুখে রাজ্যের পাঁচ এসপি ও এক ডিএম’কে কমিশন বদলি করায় মুখ্যমন্ত্রী প্রবল ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, ভোট চুকতেই ওঁদের ফিরিয়ে এনেছিলেন পুরনো পদে। জ্যোতি বসুর আমলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে তদানীন্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষনের বিরোধ তো বহুচর্চিত।

ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি যা-ই হোক, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে হিংসা-ছাপ্পাভোটের কালির দাগ রুখতে এখন থেকেই কোমর বাঁধছে কমিশন। ‘‘নির্বাচন কমিশন কোনও ব্যক্তি নয়। প্রতিষ্ঠান। যে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মজবুত করতে সাহায্য করছে।’’— বলছেন প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE