বছরের শুরুতে যা ঘোষণা ছিল, বছরের শেষে গিয়ে তার সঙ্গে বাস্তবের আসমান-জমিন ফারাক হয়ে গিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের তৃতীয় আর্থিক বছরের (২০১৩-’১৪) বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানিয়েছিলেন, রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার মধ্যে বেঁধে রাখা হবে। কিন্তু বছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা! দিন কয়েক আগে ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরের আয়-ব্যয়ের যে হিসেব (প্রভিশনাল) পেশ করেছে প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (পিএজি), সেখানেই এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অর্থ দফতরের কর্তারাই বলছেন, এমন লাগামছাড়া রাজস্ব ঘাটতি স্মরণকালের মধ্যে হয়নি।
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম বলে, রাজস্ব ঘাটতি কমাতে এক দিকে আয় বাড়াতে হয়, অন্য দিকে জোর দিতে হয় খরচ কমানোর দিকে। কিন্তু শিল্পহীন রাজ্যে আয় যেমন বাড়েনি, তেমনই অহেতুক খরচ কমানোর দিকেও মোটেই নজর দেয়নি সরকার। বাজার থেকে ধার করে তারা কোনও রকমে অবস্থা সামাল দিয়েছে। এখন আর্থিক পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ঘাটতি কমানোর কোনও পথই খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থ দফতরের কর্তারা।
আয়তন বা জনসংখ্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুল্যমূল্য বেশ কিছু রাজ্য কিন্তু এই দুই পথে হেঁটে আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরাতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই হয় তাদের রাজস্ব উদ্বৃত্ত হয়েছে, নয়তো রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাজার থেকে নেওয়া ঋ
ণের পরিমাণও কমাতে পেরেছে তারা।
যেমন, গুজরাত। পিএজি বলছে, গত আর্থিক বছরে সে রাজ্যে রাজস্ব উদ্বৃত্ত হয়েছে ৫ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। অন্ধ্রপ্রদেশেও উদ্বৃত্ত ১ হাজার ৬৬৯ কোটি। এমনকী, পড়শি বিহারেও উদ্বৃত্ত রাজস্বের পরিমাণ ৭ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। মহারাষ্ট্র সরকার বাজেট পেশের সময় ১৫ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির কথা জানালেও বছর শেষে তা ৬ হাজার ২১৯ কোটি টাকায় আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের হাল এ রকম কেন?
অর্থমন্ত্রী এর দায় চাপিয়েছেন পূর্ববর্তী বাম সরকারের উপর। অমিত মিত্রের কথায়, “বাম জমানার ৩৪ বছরে এ রাজ্যে ৫৮ হাজার কল-কারখানা বন্ধ হয়েছে। শ্মশানে পরিণত হয়েছে শিল্পক্ষেত্র। তাই কর আদায়ের কাঠামোটাই ভেঙে পড়েছিল। গত তিন বছরে নতুন সরকার সেই অবস্থার পরিবর্তন করতে নেমেছে।”
কিন্তু পরিস্থিতির যে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি, তা জানাচ্ছেন অর্থ দফতরের কর্তারাই। ২০১৩-’১৪ সালে ৩৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিজস্ব কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল রাজ্য। বছর শেষে সেটা দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার কোটিতে। রাজ্যের নিজস্ব আয়ের ৭৫% আসে মূল্যযুক্ত কর বা ভ্যাট থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই, যে রাজ্যে যত বেশি আর্থিক কারবার চলে, সেই রাজ্যে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ তত বেশি হয়। কিন্তু রাজ্যে নতুন কল-কারখানা প্রায় হয়নি। নতুন-পুরনো মিলিয়ে বিনিয়োগও নগণ্য। গত বছর বড় মাপের ব্যবসা, বাণিজ্য-সহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও তেমন কিছু ছিল না। ফলে গত বছর ১ এপ্রিল বাণিজ্য করের হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া যায়নি।
শিল্প না-থাকার কারণে ভ্যাট আদায়ের নিরিখে সমতুল রাজ্যগুলির থেকে অনেকটাই পিছনে পড়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। গত আর্থিক বছরে অন্ধ্রপ্রদেশে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা, গুজরাতে ৪০ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, আর মহারাষ্ট্রে ৬২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে এ রাজ্যের ছবিটা অনেকটাই বিবর্ণ, ২১ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। নবান্নের এক কর্তার কথায়, “এই ছবিটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজ্যে কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গতি না-আসায় ভ্যাট আদায়ও বাড়েনি। আদায় বাড়েনি বলে নিজস্ব আয়ও বাড়েনি। অন্যান্য রাজ্য এখানেই আমাদের টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।”
এই অবস্থার জন্য বাম জমানাকেই দায়ী করে অর্থমন্ত্রী বলছেন, “গত ৪০ বছরে মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, গুজরাতে নতুন নতুন শিল্প এসেছে। আর এ রাজ্যে বাম আমলে শিল্প অন্যত্র চলে গিয়েছে। এর পরেও কর আদায় বাড়বে কোথা থেকে?” যার জবাবে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, “আমরা শিল্প আনার চেষ্টা করেছিলাম। অনেক শিল্প এসেওছিল। কিন্তু এরা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। শিল্প না-হলে তো রাজ্যের রোজগার বাড়তে পারে না।”
কর আদায় না-বাড়লেও খরচে রাশ টানেনি মমতা-সরকার। উল্টে বছরভর নানা মেলা, উৎসব, পুরস্কার বিতরণ করে বা ক্লাবগুলিকে অনুদান দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কল্লোল দত্তের কথায়, “যে রাজ্যে কলকারখানা নেই, সেখানে সরকারের রাজকোষ ভরবে কীসে? এত ‘শ্রী’ দেওয়ার পিছনে টাকা খরচ করে সরকার রাজ্যের হতশ্রী অবস্থা করে ছেড়েছে। খরচে লাগাম না-টানলে কখনও রাজস্ব উদ্বৃত্ত হতে পারে না।” পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে ব্যয়বৃদ্ধির ঠেলায় পরিকল্পনা খাতে খরচ কমেছে। যার জেরে বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় অনুদান কম এসেছে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। যা বাড়িয়েছে রাজস্ব ঘাটতি। অর্থ দফতরের এক কর্তা অবশ্য বলছেন, “গত বছর কেন্দ্রের হাঁড়ির হাল ছিল। তাই বছরের শেষের দিকে রাজ্যগুলিকে প্রায় কোনও অর্থই দেননি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। কেন্দ্রীয় করের অংশ কম মিলেছে। রাজ্যের বেহাল আর্থিক দশার অন্যতম কারণ এটাও।”
সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির জন্য শিল্পের অভাবকে অংশত দায়ী করছেন রাজ্য চতুর্থ অর্থ কমিশন এবং পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো ও বিত্ত উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকারও। তাঁর কথায়, “একে শিল্প-কারখানা নেই, তার উপর বাঙালি স্বভাব সঞ্চয়ী। খরচ করলে তারা গাড়ি কেনে না, ইলিশ কেনে। ইলিশের উপরে তো আর ভ্যাট নেই! সরকারের আয় বাড়বে কী করে!” এই অবস্থায় সরকার খরচ বাড়ালে ঘাটতি বাড়তে বাধ্য, বলছেন অভিরূপবাবু।
তবে কোষাগারের বেহাল দশার জন্য আগের বাম সরকারকে দুষছেন অর্থনীতির এই শিক্ষকও। তাঁর মতে, “বাম জমানাতেই রাজ্যের আর্থিক বিশৃঙ্খলা মারাত্মক আকার নেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধার করার প্রবণতা। এই সরকার আসার পরে কর আদায়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তার সুফলও ফলতে শুরু করেছে।”
অর্থমন্ত্রীও বলছেন, “বাম জমানার শেষ বছরে রাজ্যের নিজস্ব কর আদায় হয়েছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। তিন বছর পর ২০১৩-’১৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৪ হাজার কোটি। রাজ্য জুড়ে নতুন নতুন কারখানা তৈরির কাজ শুরু হওয়াতেই এই বৃদ্ধি।”
অমিতবাবুর এই যুক্তিই রাজ্যসভায় তুলে ধরেন তৃণমূলের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। তিনি বলেছেন, “মাননীয় অর্থমন্ত্রী, অনুসরণের মতো একটাই মডেল, বেঙ্গল মডেল। ২০১২ থেকে ২০১৪-র মধ্যে রাজ্যের রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৮৭%।” এই ‘বিপুল’ বৃদ্ধিতেও শ্লাঘা বোধ করার পরিবর্তে শঙ্কিতই অর্থ দফতরের কর্তারা। এক জনের মন্তব্য, “রেকর্ড রাজস্ব ঘাটতির সঙ্গে চলতি অর্থবর্ষের শেষে ঋণের বোঝা দাঁড়াবে প্রায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬-’১৭ নাগাদ রাজ্যের পুরো আয়ই সম্ভবত ঋণ ও সুদ মেটাতে চলে যাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy