Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

দুর্বৃত্ত থেকে দেশদ্রোহী, পরিবর্তন নেই প্রশ্রয়ের

গুলিভর্তি, চকচকে রিভলভারটা যুবকের কোমরে গোঁজা ছিল। তাকে বমাল পাকড়াও করতে না-করতেই গার্ডেনরিচ থানার ওসি টেলিফোন কলটা পেলেন। ‘আরে, কী করেছেন? ওকে ছেড়ে দিন! ও ভাল ছেলে!’ যেন হুকুম দিলেন সিপিএমের দাপুটে নেতা। ওসি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘ভাল ছেলের কাছে রিভলভার থাকবে কেন?’

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:১০
Share: Save:

গুলিভর্তি, চকচকে রিভলভারটা যুবকের কোমরে গোঁজা ছিল। তাকে বমাল পাকড়াও করতে না-করতেই গার্ডেনরিচ থানার ওসি টেলিফোন কলটা পেলেন।

‘আরে, কী করেছেন? ওকে ছেড়ে দিন! ও ভাল ছেলে!’ যেন হুকুম দিলেন সিপিএমের দাপুটে নেতা।

ওসি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘ভাল ছেলের কাছে রিভলভার থাকবে কেন?’

নেতা হেসে ফেললেন, ‘গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজে তো সবার কাছেই রিভলভার-পিস্তল আছে। এটা কোনও অপরাধ হল!’

রামেশ্বরপুর রোডের এই ঘটনা বিশ বছর আগের। শেষমেশ গ্রেফতার না-করেই যুবককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। পুলিশের উপর প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠেছিল তৎকালীন শাসক দল, সিপিএম নেতা দিলীপ সেনের বিরুদ্ধে।

দিলীপবাবু এখন পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। সোমবার তিনি দাবি করলেন, ‘‘আমি কখনও এ রকম কথা বলতে পারি না। আমি বরাবর পুলি‌শকে সহযোগিতা করেছি।’’ যদিও পুলিশ তো বটেই, স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশও বলছেন, বন্দর এলাকায় দুষ্কৃতীদের আগলানোটা শাসক দলের দস্তুর। পরিবর্তনের পরেও সেই ধারা বজায় রয়েছে পুরোমাত্রায়। রংটা শুধু পাল্টেছে। গার্ডেনরিচ থেকে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা সন্দেহভাজন পাক চরদের গ্রেফতার সেই সত্যটাই সামনে এনে দিয়েছে।

পুলিশ-গোয়েন্দাদের বড় অংশ এতে বিস্ময়ের কিছু দেখছেন না। তাঁদের বক্তব্য, দুর্বৃত্তেরা দীর্ঘকাল ধরেই বন্দরের বিস্তীর্ণ এলাকায় নিশ্চিন্তে থাকে। পুলিশ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। খিদিরপুরের বিভিন্ন তল্লাটে যেমন বহু গৃহস্থ বাড়ির সামনে রাস্তায় চেয়ার পেতে, মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে মাঝরাত পেরিয়ে গেলেও চলে ‘হল্লাচিল্লা’। বাসিন্দারা অভিযোগ জানালে পুলিশ মাঝেমধ্যে পৌঁছয়। কিন্তু অভিযুক্তরা জানিয়ে দেয়, তারা তৃণমূল করে। প্রমাণ ওই সবুজ চেয়ার। পুলিশ গুটি গুটি পায়ে ফিরে যায়। এলাকাবাসীদের দাবি, এই ঘটনা নিত্যদিনের। অপরাধের এই স্বর্গরাজ্যে গুপ্তচর, দেশদ্রোহীরাও যে আশ্রয় নিতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক পোড় খাওয়া গোয়েন্দা-কর্তা স্বীকার করছেন, ‘‘বন্দর এলাকায় মস্তান, দুষ্কৃতীদের আশ্রয় দিতে দিতে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ দেশদ্রোহীদেরও আশ্রয় দেওয়া শুরু করেছেন ভোটের স্বার্থে।’’

লালবাজারের একাধিক কর্তাও স্বীকার করছেন, মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ, ওয়াটগঞ্জের কিছু তল্লাটে পুলিশ ঢুকতে পারে না। এক শীর্ষ অফিসারের কথায়, ‘‘কোনও তল্লাট সাধারণ অপরাধীর পক্ষে নিরাপদ হলে জঙ্গি, গুপ্তচরদের তো সেটা আশ্রয় হবেই। উত্তরপ্রদেশের মেরঠে পাক চর ইজাজ ধরা পড়ার সূত্রে সেটাই ফের প্রমাণিত হল।’’ কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) দাবি, ইজাজের জন্য সমস্ত পরিচয়পত্র তৈরি করে দিয়েছিল গার্ডেনরিচের জাহাঙ্গির। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে জাহাঙ্গির-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে এসটিএফ।

২০০৮-এর জুলাই মাসে এসটিএফ গড়ে ওঠার আগে নজরদারির কাজটা মূলত করত স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সেল। তাদের কাজে বাধা দেওয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় কয়েকটি থানার পুলিশের বিরুদ্ধেও। তবে এসটিএফ গঠিত হওয়ার পরে এই ধরনের অভিযোগের সংখ্যা কমে আসে। কারণ, এসটিএফের ক্ষমতা অনেক বেশি। স্থানীয় পুলিশের উপরে তাদের নির্ভরতাও নেই। যদিও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের চরিত্রে রদবদল বিশেষ ঘটেনি। যেমন ২০১২-র এপ্রিলে লোহাবাড়ি মসজিদ তালাওয়ের বিস্ফোরণের ঘটনায় শাসক দলের লোকজন পুলিশকে দীর্ঘক্ষণ ঢুকতেই দেয়নি বলে অভিযোগ।

বন্দরের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের যে একটা যোগসূত্র রয়েছে সেটা দীর্ঘদিন ধরেই গোয়েন্দাদের জানা। এ ব্যাপারে বড়সড় প্রমাণ তাঁদের হাতে আসে কন্দহরে বিমান ছিনতাইয়ের তদন্তের সময়। ১৯৯৯-এর ২৪ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লিগামী বিমানে যাত্রীর ভেক ধরে উঠেছিল পাক জঙ্গিরা। তারা বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে ভারতে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিল বেনিয়াপুকুরের হোটেলে। তার পর জাল পাসপোর্ট নিয়ে নেপালে চলে যায়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা তখন জানিয়েছিলেন, হরকতের স্লিপার সেল-এর এক সদস্যই জাল ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়েছিল। লোকটি ছিল বন্দরের একবালপুরের বাসিন্দা।

২০০৪-এ স্পেশাল ব্রাঞ্চের নজরে পড়ে, একবালপুর, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো প্রচুর বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু কারা টাকা ঢালছে, কারাই বা ফ্ল্যাট কিনছে, সেটা পরিষ্কার নয়। এসবি-র তৎকালীন ডিসি প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বিস্তারিত ভাবে খোঁজখবর করে রিপোর্ট পেশ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু গোয়েন্দারা দু’-তিনটি জায়গায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার পরেই থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের কেউ কেউ লালবাজারে অভিযোগ করে বলেন, এসবি যা করছে তাতে এলাকায় অশান্তি হবে। এসবি-র দাবি ছিল, ওই বেআইনি নির্মাণ থেকে থানার অফিসারদের একাংশ নিয়মিত টাকার ভাগ পান। কিন্তু সেই কারণে ব্যাপারটা চেপে যাওয়া হলে ওই সব বহুতল তৈরিতে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের টাকা আসছে কি না, সেটা জানা যাবে না। কিন্তু পুলিশ সূত্রের খবর, লালবাজারের কর্তারাই তখন এসবি-কে এগোতে বারণ করে দিয়েছিলেন।

বছর দশেক আগে গার্ডেনরিচের বিচালিঘাট রোডে এক গয়নার দোকানের মালিক যে পাক মদতে পুষ্ট একটি জঙ্গি সংগঠনের স্লিপার সেল-এর সদস্য, সে কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা। কিন্তু ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে গেলে এক সিপিএম কাউন্সিলর দলবল নিয়ে রুখে দাঁড়ান বলে অভিযোগ। ওই অভিযানে থাকা এক অফিসারের (এখন তিনি ইনস্পেক্টর) কথায়, ‘‘কাউন্সিলর বললেন, ‘ওকে নিয়ে যান, কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু কেন নিচ্ছেন, সেটা তো আগে আমাকে দেখতে হবে।’’ ওই ইনস্পেক্টর বলেন, ‘‘ওই লোকটা যে ভারতীয় নয়, তার প্রমাণ কাগজেকলমে আমাদের হাতে ছিল না। বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটি। পরে জানা যায়, কাউন্সিলরের লোকজনই তাকে ভারতীয় পাসপোর্ট, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র, রেশন কার্ড তৈরি করে দিয়েছিল!’’

আবার ২০০৬-এ ওয়াটগঞ্জ স্ট্রিটের একটি বস্তিতে এক পাক চরের থাকার কথা ও তার কাছে পাকিস্তান থেকে নিয়মিত সন্দেহজনক লোকজন আসাযাওয়ার বিষয়টি নিয়েও দফায় দফায় রিপোর্ট দিয়েছিলেন ওয়াটগঞ্জ থানায় বহাল এসবি-র এক অফিসার। গোয়েন্দারা ওই বস্তিতে হানা দিলে তাঁদের ঘিরে ফেলে স্থানীয় লোকজন। এসবি-র অভিযোগ ছিল, স্থানীয় থানা সহযোগিতা তো করেইনি। বরং কেন গোয়েন্দারা ওই বস্তিতে হানা দিলেন, তা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। শেষমেশ ওই সন্দেহভাজনকে ধরা যায়নি়। ওয়াটগঞ্জ থানায় নিযুক্ত এসবি-র ওই অফিসারকে অন্যত্র সরে যেতে হয়।

এটাই বন্দর এলাকার রেওয়াজ। আশির দশকে কাচ্চি সড়ক মোড়ে দিনেদুপুরে খুন হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা শাহজাদা। বহু বছর লালবাজারের গুন্ডা দমন শাখায় কাজ করা এক অফিসার জানাচ্ছেন, ব্যারিস্টার নামে এক দুর্বৃত্ত গুলি চালায় বলে তদন্তে বেরিয়েছিল। তাকে মদত দেওয়ার দায়ে কারাদণ্ড হয় শামসুজ্জামান আনসারি নামে এক ব্যক্তির, এখন যিনি তৃণমূলের মেয়র পারিষদ। ‘‘আনসারি কবে সাজা খেটে বেরিয়ে এসে তিন-তিন বার মেয়র পারিষদ হয়ে গেলেন, অথচ তিন দশক পরেও ব্যারিস্টার ধরা পড়ল না। আমাদের খবর অনুযায়ী, সে দিব্যি মেটিয়াবুরুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে,’’ বললেন ওই অফিসার।

সেই ট্র্যাডিশনই চলছে। এখন চর-কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত আসফাক তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা বলে জানা যাচ্ছে। খিদিরপুরে ওই ছাত্র সংগঠনের আর এক নেতারও নাম উঠেছে। গত ৫ নভেম্বর তৃণমূলেরই প্রগতিশীল হকার্স ইউনিয়ন তার বিরুদ্ধে দাদাগিরির অভিযোগ দায়ের করেছে ওয়াটগঞ্জ থানায়। এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

surbek biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE