Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
ভরা সরকারি অফিস, ফাঁকা রাস্তা

সর্বাত্মক ধর্মঘটে ব্যতিক্রম হলদিয়া-দার্জিলিং

এমনটা আগে হয়নি। তৃণমূলের শাসনকালে বিরোধীদের ডাকা বন্‌ধের এমন ব্যাপক প্রভাব এ রাজ্যে দেখা যায়নি এ যাবত। শিলিগুড়ি থেকে ক্যানিং, পুরুলিয়া থেকে নদিয়া, সর্বত্র রাস্তা ছিল সুনসান, দোকান বন্ধ কিংবা ক্রেতাশূন্য। কর্মীরা না আসায় কার্যত বন্ধ থাকে বহু কল-কারখানা। বেসরকারি বাস, অটো রাস্তায় নামেনি অধিকাংশ জেলা শহর, মফস্সলে।

সুনসান রাস্তা। ছবি: দীপঙ্কর দে।

সুনসান রাস্তা। ছবি: দীপঙ্কর দে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

এমনটা আগে হয়নি। তৃণমূলের শাসনকালে বিরোধীদের ডাকা বন্‌ধের এমন ব্যাপক প্রভাব এ রাজ্যে দেখা যায়নি এ যাবত। শিলিগুড়ি থেকে ক্যানিং, পুরুলিয়া থেকে নদিয়া, সর্বত্র রাস্তা ছিল সুনসান, দোকান বন্ধ কিংবা ক্রেতাশূন্য। কর্মীরা না আসায় কার্যত বন্ধ থাকে বহু কল-কারখানা। বেসরকারি বাস, অটো রাস্তায় নামেনি অধিকাংশ জেলা শহর, মফস্সলে। দার্জিলিং আর হলদিয়া, এই দু’টি শহর বাদ দিলে এ দিন কলকাতা-সহ রাজ্যের সব অঞ্চলে জনজীবনে ভালই প্রভাব ফেলেছে শিল্প ধর্মঘট। শিল্পাঞ্চলগুলিও বন্‌ধের প্রভাব এড়াতে পারেনি।

কড়া সরকারি নির্দেশের জেরে সরকারি দফতরগুলিতে অবশ্য সর্বত্রই হাজিরা ছিল ভাল। মুখ্যমন্ত্রী সে জন্য অভিনন্দনও জানিয়েছেন সরকারি কর্মীদের। এ দিন নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ দিন সরকারি অফিসগুলিতে অন্য দিনের চেয়ে হাজিরা বেশিই ছিল।’’ কলকাতায় ৯৩ শতাংশ এবং জেলায় ৯৭ শতাংশ হাজিরা ছিল, জানান তিনি। ‘‘বাসভর্তি লোক’’ দেখেছেন বলে দাবিও করেছেন তিনি।

সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বন্‌ধ সার্থক করার জন্য রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের রাস্তা মানুষের দখলে। আর সরকার নবান্নে বন্দি! মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এক মিনিটেই শেষ করে দেবেন। ওঁর এক মিনিট হতে কত মিনিট বাকি?’’ কংগ্রেস প্রভাবিত আইএনটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি রমেন পাণ্ডের বক্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকার কর্মীদের খাইয়ে-দাইয়ে বসিয়ে রেখে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটকে ব্যর্থ দেখাতে চেয়েছে। সেটাই আমাদের সাফল্য!’’

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাল্টা দাবি করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সরকার সংযত ভাবে সিপিএমের হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনকে প্রতিহত করেছে। তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী এবং সরকারকে তৃণমূলের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ!’’

বাস্তবে এ দিন কী ছিল ছবিটা?

উত্তরে দার্জিলিং আর দক্ষিণে হলদিয়া বাদ দিলে, রাজ্যের আর কোথাও জনজীবন স্বাভাবিক ছিল না বুধবারের শিল্প ধর্মঘটে। বেসরকারি যানবাহন চলেনি, সরকারি ট্রেন-বাস প্রায় ফাঁকা, বন্ধ ছিল বহু শহরের প্রধান বাজারগুলি। কোথাও কোথাও অবশ্য তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ভয়ে দোকান খোলা রেখে সারা দিন মাছি তাড়িয়েছেন দোকানিরা। দুপর নাগাদ দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে এডডিএ ভবন-লাগোয়া এক ফলের দোকানদার বলেন, ‘‘মঙ্গলবার রাতেই তৃণমূলের থেকে বলা হয়, দোকান বন্ধ করা চলবে না। তাই সকাল থেকে বসে আছি। একটাও ফল বিক্রি হয়নি।’’

তৃণমূলের ভয়ে কোথাও কোথাও বেসরকারি বাস, অটো বেরিয়েছে রাস্তায়। যেমন, ক্যানিং অটো স্ট্যান্ডের দেওয়ালে হাতে-লেখা নোটিস সেঁটে দিয়েছিল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি। তাতে বলা হয়, বুধবার ভ্যান, টোটো যিনি বন্ধ রাখবেন, ‘শাস্তি’ হিসেবে আগামী এক মাস তাঁর গাড়ি ‘সাসপেন্ড’ করা হবে। অগত্যা স্ট্যান্ডে যাত্রিহীন দিন কাটায় প্রায় ছ’শো অটো, ভ্যান রিকশা।

তৃণমূলের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বর্ধমানের নতুনগঞ্জ বাজার, বাঁকুড়ার মাচানতলা বাজার, শিলিগুড়ির বিধান মার্কেট, বহরমপুর পুরসভা মার্কেট, শ্রীরামপুর বাজারের মতো জেলা শহরের বড় বড় বাজারগুলো ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। রামপুরহাট, তমলুক, ঘাটাল, আসানসোলের মতো অনেক শহরে প্রধান বাসস্ট্যান্ডগুলি থেকে বেসরকারি বাস বারই হয়নি। অটো, টোটো চলেনি অধিকাংশ জেলা শহরের রাস্তায়। বিক্ষিপ্ত অবরোধ সত্ত্বেও সরকারি বাস, ট্রেন অবশ্য চলেছে সারা দিনই, তবে যাত্রী ছিল হাতে-গোনা। কলকাতায় সরকারি বাসের চালককে হেলমেট পরে বাস চালাতে দেখা গিয়েছে।

বেসরকারি বাস না চলায় দিনভর রায়গঞ্জ শহর ও ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সুনসান ছিল। মালদহেও দীর্ঘক্ষণ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের। ইসলামপুরে বন্‌ধ সমর্থনকারীরা ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করলে সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে। বর্ধমানে ২ নম্বর জাতীয় সড়কও ছিল কার্যত ফাঁকা। দুই মেদিনীপুরে ৬ নম্বর ও ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে ট্রাক চলাচল অন্য দিনের মতো হলেও, যাত্রিবাহী বাস ছিল অনেক কম।

বর্ধমান শহরে কোনও বড় গণ্ডগোল না হলেও বন্‌ধ ছিল সর্বাত্মক। জেলা আদালতে সকাল বেলাতেই চলে আসেন বিচারক, আইনজীবীরা। কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা কেউ না আসায় বেলা ১২টা নাগাদ আদালত বন্ধ হয়ে যায়। কল্যাণী ও ব্যারাকপুর মহকুমা আদালতেও এ দিন ভিড় ছিল না। শিলিগুড়ি আদালতে কয়েকটি পুলিশ কেসে জামিনের আবেদন ছাড়া আর কোনও মামলা ওঠেনি। কোচবিহার আদালতে অবশ্য অন্য দিনের মতোই কাজ হয়।

শিল্পাঞ্চলে বন্‌ধের প্রভাব পড়েছে মিশ্র। উত্তরবঙ্গের ৪০ শতাংশ চা বাগানে কাজ হয়নি। হুগলির ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানির চটকল খোলা থাকলেও শ্রমিকদের উপস্থিতি প্রায় ছিল না। কল্যাণী শিল্পাঞ্চলের কারখানায় হাজিরা ছিল কম। খড়্গপুরের নিমপুরা, বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে হাজিরা কম হলেও উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। উত্তর ২৪ পরগনার ঘোজাডাঙা সীমান্তে আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক ছিল।

আসানসোল-দুর্গাপুর খনি-শিল্পাঞ্চলে অবশ্য কল-কারখানায় কাজ হয়েছে। তবে হাজিরার হার অন্য দিনের তুলনায় কম ছিল। ইসিএল সূত্রে জানা যায়, সকালের পালিতে (শিফ্‌ট) হাজিরার হার ছিল ৭৬ শতাংশ, যা কিছুটা কম। তবে বার্নপুরের ইস্কো কারখানা থেকে দুর্গাপুর প্রোজেক্টস লিমিটেড—সর্বত্রই হাজিরা স্বাভাবিক ছিল।

আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী অবশ্য দাবি করেন, ‘‘অন্য বারের তুলনায় ইস্কোতেও এ বার ধর্মঘট ভাল হয়েছে। ইসিএলের অন্তত সাতটি এরিয়ায় সর্বাত্মক হয়েছে ধর্মঘট।’’ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলি প্রায় বন্ধ ছিল, দাবি তাঁর। আইএনটিটিইউসি-র বর্ধমান জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায় যদিও বলেন, ‘‘শ্রমিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করে কাজে যোগ দিয়েছেন।’’

এ দিন নানা জেলায় বেশ কিছু স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও পড়ুয়া ছিল কম। চন্দননগরের খলিসালি কলেজে ক্লাস না হওয়ায় টিএমসিপি সমর্থকেরা অধ্যক্ষকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায়। যদিও শিক্ষকদের একাংশের দাবি, ক্লাসে পড়ুয়া প্রায় ছিল না বলেই ক্লাস নেওয়া যায়নি। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দিন পরীক্ষা ছিল। নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিয়েছেন সব পরীক্ষার্থীই।

বন্‌ধের প্রভাব পড়েনি দার্জিলিঙে। সেখানে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা আগেই বন্‌ধ বিরোধিতার কথা ঘোষণা করেছিল। সেখানে স্কুল-কলেজ, দোকান-বাজার সবই ছিল খোলা। অন্য দিকে, হলদিয়ায় এ দিন সকালে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী যান এইচডিএ দফতরে। পরে হলদিয়া সংশোধনাগারে গিয়ে সকলের হাজিরা দেখেন। সরকারি ও বেসরকারি, হলদিয়ার সব সংস্থাতেই পুরোদস্তুর কাজ হয়েছে এ দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE