Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
দিনভর ঘিরে রইল পুলিশ

মা-কে না পেয়ে কান্না জুড়ল শিশু

রাত থেকেই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল। যে, সাত্তোরের নির্যাতিতা, তাঁর স্বামী ও শ্বাশুড়ি-সহ ছ’জনকে পুলিশ ধরেছে। কিন্তু সেটা গ্রেফতার না আটক? জেলা পুলিসের তরফে ফোন, এসএমএসে তার উত্তর মেলেনি রাত পর্যন্ত।

ঢুকতে মানা। কড়া পাহাড়ায় সাত্তোরের নির্যাতিতাকে সিউড়ি আদালতে হাজির করাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

ঢুকতে মানা। কড়া পাহাড়ায় সাত্তোরের নির্যাতিতাকে সিউড়ি আদালতে হাজির করাচ্ছে পুলিশ বাহিনী। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

রাত থেকেই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল। যে, সাত্তোরের নির্যাতিতা, তাঁর স্বামী ও শ্বাশুড়ি-সহ ছ’জনকে পুলিশ ধরেছে। কিন্তু সেটা গ্রেফতার না আটক? জেলা পুলিসের তরফে ফোন, এসএমএসে তার উত্তর মেলেনি রাত পর্যন্ত। কিন্তু নির্যাতিতা যে গ্রেফতার হয়েছেন, অনুমান করেই রবিবার সকাল থেকে সংবাদমাধ্যমের নজর ছিল জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দিকে। কারণ, ওই চত্বরেই রয়েছে সিউড়ি আদালতের কোর্ট লক-আপ। কাউকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হলে, প্রথমে অভিযুক্তকে সেখানেই আনা হয়।

নিছক মিথ্যে হয়নি সংবাদমাধ্যমের অনুমান। এ দিন বেলা গড়াতেই তার নজির মিলতে শুরু করল। বেলা ১১টা থেকেই পুলিশ কর্মীদের তৎপরতা, অধিক সংখ্যায় মহিলা পুলিশ কর্মীর উপস্থিতি এবং জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেখে অনুমান আরও দৃঢ় হয়। পুলিশেরই একটি মহল থেকে জানা যায়, নির্যাতিতা ও তাঁর শ্বাশুড়িকে গত রাতেই সিউড়ির মহিলা থানায় এনে রাখা হয়েছে।

সকাল সাড়ে ১১টা। পাড়ুই থানা থেকে নির্যাতিতার স্বামী-সহ চারজনকে আনা হয় সিউড়িতে। প্রায় একই সময় সিউড়ির মহিলা থানা কোর্ট লক আপে নিয়ে আসা হয় নির্যাতিতা ও তাঁর শ্বাশুড়িকেও। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বন্ধ করে দেওয়া হয় পুলিশ সুপারের দফতরের মূল গেটও। পুরো চত্বর ঘিরে রাখে পুলিশ-বাহিনী। ছিলেন অন্তত জানা কুড়ি মহিলা পুলিশ কর্মী। ছিলেন ডিএসপি আব্দুল আজিম ও সিউড়ি থানার আইসি সমীর কোপ্তি।

বিজেপি-র জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা বলেন, ‘‘পুলিশ আর তৃণমূলকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ওরা হরিহর আত্মায় পরিণত হয়েছে। তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে বোমা মিলেছে। পুলিশ কি করে উদ্ধার করবে! দলের মুখ পুড়বে তো। তাই আমাদের কর্মী-সমর্থকদের এ ভাবে মিথ্যা ফাঁসানো হল। মধ্যযুগীয় বর্বরতার নজির সৃষ্টির পরে নির্যাতিতাকে এই গ্রেফতার আসলে প্রমাণ করে, পুলিশ তার নিরপেক্ষতাকে একটি বিশেষ দলের কাছে বিকিয়ে দিয়েছে।’’ নির্যাতিতার মনোবল ভেঙে দিতেই পুলিশের এই অতি সক্রিয়তা বলেও তাঁর দাবি।

ঘণ্টা দেড়েক পর, বেলা একটার দিকে সিজেএম আদালতে নির্যাতিতা-সহ সকলকে নিয়ে আসা হয়। বিজেপির তরফে ব্যারাকিং হতে পারে আন্দাজ করে ততক্ষণে আদালত চত্বর ঘিরে ফেলে প্রচুর সংখ্যায় পুলিশ। নিরাপত্তার বেড়াজাল দেখে মনে হয়, যেন কোনও ভিভিআইপিকে আদালতে তোলা হচ্ছে! একটি কালো প্রিজন ভ্যানে নির্যাতিতা-সহ সকলে আদালতে আসেন। পিছনে আরও দুটি পুলিশের গাড়ি। প্রিজনভ্যান নিয়ে আসার সময় বিজেপির পতাকা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা যায় নির্যাতিতার জা-সহ উপস্থিত আন্যান্যদের।

আদালত কক্ষে সকলকে ঢোকানোর পরই বন্ধ করে দেওয়া হয় দরজা। সংবাদমাধ্যের সব প্রতিনিধিও আদালতে ঢুকতে পারেননি। এমনকী বিজপির জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা আদালতে ঢুকতে চাইলেও তাঁকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আদালতের বাইরেই তখন পুলিশের ভূমিকার নিন্দা করেন অর্জুনবাবুরা। বিক্ষোভ দেখাতে থাকে বিজেপি। মামলা উঠলে, ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিষ্ট্রেট ঋষি কুশারির কাছে সকলের জন্য জামিনের আবেদন করেন অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী তথা বিজেপি নেতা নির্মল মণ্ডল। নির্মলবাবু বলেন, ‘‘শনিবার পাড়ুইয়ের সাত্তোরে তৃণমূলের পার্টি আফিসে বোমা পাওয়া গিয়েছিল। সেটা উদ্ধার না করে ঘটনাটিকে ধামা চাপা দেওয়ার জন্যই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে এঁদের। যেহেতু নির্যাতিতার উপর অত্যাচারের ঘটনায় পুলিশের নাম উঠেছে, ওঁকে গ্রেফতার করার পেছেনে পুলিশের হাত রয়েছে।’’

অন্য দিকে, নির্যাতিতার জায়ের কাছে তাঁর বছর চারেকের শিশুপুত্র মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে। নির্মলবাবু বলেন, ‘‘শিশুটিকেও পুলিশ তুলে এনেছিল। ও মা-বাবা এবং ঠাকুমা ছাড়া কোথায় থাকবে। বিচারক শিশুটিকে মায়ের সঙ্গে থাকার অনুমতি দিন।’’ বিচারক সে অনুমতি দিলে শিশুটি নির্যাতিতার সঙ্গেই জেল হাজতে যায়। দেড়টা নাগাদ নির্যাতিতাকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান আদালত ছাড়ে নিরাপত্তার মোড়কেই। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি কিছু বলতে চাইলেও সেই সুযোগ পুলিশ তাঁকে দেয়নি।

বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার বলেন, ‘‘যারা তৃণমূল কার্যালয়ে বোমা দেখালো, তাদেরকেই তুলে ভরে দিল পুলিশ। অথচ বোমা উদ্ধারের কোনও রকম ভূমিকা তারা নিল না। আর যেহেতু নির্যাতিতাকে আগে পুলিশ অত্যাচার করেছে, তিনি বহু পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা লড়ছেন, তাঁর মনোবল ভেঙে দিতেই মিথ্যা মামলায় এই গ্রেফতারি। এটা একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা।’’

সরকারি আইনজীবী বিকাশ পৈতণ্ডী বলেন, ‘‘একটি বেআইনি পথ অবরোধের ঘটনা সাত্তোরে ঘটেছে। পুলিশ সেটা তুলতে গেলে, অভিযুক্তরা পুলিশকে অকথ্য গালিগালাজ করে। হেনস্থা করার অভিযোগও হয়েছে। বোমা পড়ে, দুটি জামিন অযোগ্য ধারাও রয়েছে। তাই জামিনের বিরোধিতা করছি। দু’ পক্ষের বক্তব্য শোনার পর জামিন না মঞ্জুর করেন বিচারক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE