পরপর দু’দিন তিন-তিনটি মামলায় প্রশাসনের গড়িমসির জন্য রাজ্য সরকারকে দুরমুশ করল কলকাতা হাইকোর্ট।
বৃহস্পতিবার বেসরকারি অর্থ লগ্নি সংস্থা এমপিএসের ক্ষতিগ্রস্ত লগ্নিকারীদের টাকা ফেরতের মামলায় রাজ্যের গড়িমসি দেখে হাইকোর্ট বলেছিল, সরকার নাটক করছে।
তার পরের দিনই, শুক্রবার রাজ্যের দুই প্রাক্তন কর্মীর মামলায় উচ্চ আদালতের মন্তব্য, কোনও সরকারি কর্মীর পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেওয়ার কথা উঠলেই তো রাজ্য সরকার এবং অডিটর জেনারেল সেই কর্মীকে নিয়ে ফুটবল খেলেন! নিজের কর্মীদের অবসরকালীন পাওনা মেটানোর ব্যাপারে গড়িমসির জেরে আদালত অবমাননার দু’-দু’টি মামলায় এ দিন ভর্ৎসিত হতে হল রাজ্য সরকারকে।
বারবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সরকার লগ্নি সংস্থা এমপিএসের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটিতে নোডাল অফিসার নিয়োগ করেনি। বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকার নাটক করছে বলে আগের দিন মন্তব্য করেন হাইকোর্টের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। আর এ দিন জোড়া মামলায় সরকারকে তিরস্কার করে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি তাপস মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। এবং সরকারকে সেই ভর্ৎসনা করা হয় রাজ্যের অর্থসচিব ও খাদ্যসচিবকে সামনে রেখেই।
অবসরের পাঁচ বছর পরে মারা গিয়েছেন এক রাজ্য সরকারি কর্মী। কিন্তু অবসরকালীন পাওনাগণ্ডা পায়নি তাঁর পরিবার। এই অবস্থায় হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন তাঁর স্ত্রী। আদালত পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি। তার পরে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি তাপস মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে আদালত অবমাননার মামলা করেন ওই মহিলা। এ দিন সেই মামলার শুনানির সময়েই বিচারপতি মাত্রে মন্তব্য করেন, ‘‘পাওনাগণ্ডা মেটানোর কথা হলেই রাজ্য এবং অডিটর জেনারেল সরকারি কর্মীদের নিয়ে ফুটবল খেলেন।’’ ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, মৃত ওই সরকারি কর্মীর আইনি উত্তরাধিকারীর হাতে অবিলম্বে সমস্ত বকেয়া টাকা তুলে দিতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত অন্য এক সরকারি কর্মীর পাওনা মেটানোর ব্যাপারে আদালতের নির্দেশ না-মানায় এ দিন আরও একটি আদালত অবমাননার মামলা ওঠে একই ডিভিশন বেঞ্চে। সেই মামলাতেও বিচারপতি মাত্রের পর্যবেক্ষণ, সরকারি কর্মীদের অবসরকালীন পাওনা বা বকেয়া মেটানোর ক্ষেত্রে সরকার অনেক সময়েই হাইকোর্টের নির্দেশ মানছে না। এ দিন ওই মামলা উঠলে সরকারি কৌঁসুলি তা মুলতুবি রাখার আবেদন জানান। ডিভিশন বেঞ্চ সেই আর্জি খারিজ করে দেয়। তারা নির্দেশ দেয়, বেলা সওয়া ১টায় অর্থসচিব ও খাদ্যসচিবকে আদালতে হাজির হয়ে জানাতে হবে, কেন ওই কর্মীর বকেয়া প্রাপ্য এখনও মেটানো হয়নি।
অবসরপ্রাপ্ত ওই সরকারি কর্মীর নাম মনোজকুমার ঘোষ। তিনি বেহালার বাসিন্দা। তাঁর আইনজীবী অভিজিৎ রায় জানান, তাঁর মক্কেল রাজ্যের খাদ্য দফতরের কর্মী ছিলেন। অবসর নেন ১৯৮৫ সালে। কিন্তু তাঁর বকেয়া মেটানো হয়নি। পেনশনও চালু হয়নি। স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল (স্যাট) বা রাজ্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন মনোজবাবু। স্যাট একাধিক বার তাঁর অনুকূলে রায় দিয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার তা কানেই তোলেনি।
মনোজবাবু হাইকোর্টে মামলা করেন। স্যাটের বিভিন্ন নির্দেশ খতিয়ে দেখে ২০১৩ সালের ১৭ মে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, আট সপ্তাহের মধ্যে তাঁর যাবতীয় বকেয়া মিটিয়ে দিতে হবে। তার পরেও তাঁর প্রাপ্য মেটানো হয়নি। এর পরে বিচারপতি মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন ওই বৃদ্ধ। এ দিন তাঁর আইনজীবী জানান, গত ৫ অগস্ট ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, ১৯ অগস্টের মধ্যে সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে, মনোজবাবুর পেনশন চালু করে আদালতে রিপোর্ট পেশ করতে হবে। সেই নির্দেশও মানা হয়নি।
আবেদনকারীর এই বক্তব্য শুনে সরকারের দুই সচিবকে তলব করে উচ্চ আদালত। দুপুরে রাজ্যের অর্থসচিব ও খাদ্যসচিবকে এজলাসে হাজির হন। দুই সচিবের উপস্থিতিতে রাজ্য সরকারকে ভর্ৎসনা করে ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, যে-ভাবেই হোক, আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মনোজবাবুর অবসরকালীন সব পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে এবং চালু করে দিতে হবে তাঁর পেনশন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy