Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
অপরাধ কী, খুঁজছে কোর্ট

তাপস মামলায় আজ আবার শুনানি

অপরাধের ইচ্ছে প্রকাশ করলেই তা অপরাধ হয় না, তাপস পাল-মামলায় এমনই মন্তব্য করল হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্ত এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চে আজ, বৃহস্পতিবার এই মামলার ফের শুনানি হবে। আজ বেলা দুটো পর্যন্ত তাপস পালের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার বিষয়টি স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিচারপতিরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০২:৫০
Share: Save:

অপরাধের ইচ্ছে প্রকাশ করলেই তা অপরাধ হয় না, তাপস পাল-মামলায় এমনই মন্তব্য করল হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।

বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্ত এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চে আজ, বৃহস্পতিবার এই মামলার ফের শুনানি হবে। আজ বেলা দুটো পর্যন্ত তাপস পালের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার বিষয়টি স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিচারপতিরা।

এর আগে সোমবার বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন, উস্কানিমূলক বক্তব্য (হেট স্পিচ) রাখার দায়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাপস পালের বিরুদ্ধে পুলিশকে এফআইআর দায়ের করতে হবে। তদন্তের ভার দিতে হবে সিআইডি-কে। বৃহস্পতিবার বিকেলে সেই সময়সীমা পার হওয়ার কথা। তার আগেই ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে এ দিন ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে রাজ্য। কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস নিজেও পৃথক ভাবে একটি আপিল মামলা করেছেন। দুটি মামলাই একত্রে শুনছে ডিভিশন বেঞ্চ।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

এ দিন বেলা সাড়ে ১০টায় রাজ্য সরকারের পক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনজিত্‌ সিংহ এবং আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আপিল মামলাটি দায়ের করতে যান বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চে। ওই বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, এই মামলা শোনার এক্তিয়ার তার নেই। বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ মামলাটি শুনতে পারে। কল্যাণবাবু এবং পিপি তখন বিচারপতি গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে গিয়ে আপিল মামলাটি এ দিনই শোনার জন্য অনুরোধ করেন। তাপসের আইনজীবী কিশোর দত্ত। একই অনুরোধ করেন। বিচারপতি গুপ্ত জানান, বেলা দু’টোয় শুনানি হবে।

শুনানির শুরুতেই বিচারপতি গুপ্ত তাপস পালের আইনজীবীর কাছে জানতে চান, “কী ঘটেছিল আপনি আমাকে জানান।” কিশোরবাবু বলেন, তাঁর মক্কেলের একটি বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তার প্রেক্ষিতে উত্তর দমদম পুরসভা এলাকার বাসিন্দা বিপ্লব চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার মামলা দায়ের করেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের আদালতে। তাঁর মক্কেল ইতিমধ্যেই ওই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁর ক্ষমা চাওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার পরেও তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে পুলিশকে এফআইআর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সিআইডি তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি দত্ত।

বিচারপতি গুপ্ত এ বার আইনজীবী কল্যাণবাবুর কাছে জানতে চান, “ডিভিশন বেঞ্চে রাজ্য সরকারের আপিল করার কারণ কী?” কল্যাণবাবু আদালতে দাবি করেন, “সাংসদের বক্তব্যের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেও জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল। তাপস আদালতগ্রাহ্য কোনও অপরাধ করেননি বলেই সেখানে মামলাটি খারিজ হয়। তাই কলকাতা হাইকোর্টের ওই মামলা গ্রহণ করার এক্তিয়ারই নেই।” কল্যাণবাবুর দাবি, তাপস মুখে যাই বলুন, তিনি বাস্তবে গুলি চালাননি এবং তাঁর বক্তব্যের জেরে এলাকায় হিংসা ছড়িয়েছে, এমন নজিরও নেই। তাঁর মন্তব্য, “বিচারপতি দত্ত যে সব মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাতে মানুষ পুলিশ-প্রশাসনের উপরে ভরসা হারাবে। এক জন সাংসদের কী করণীয়, হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ তা বলতে পারে না। বিচারপতি নিজেই সব করে দিচ্ছেন। পুলিশ-প্রশাসনের তা হলে দরকার নেই।”

এর পরে বিচারপতি গুপ্ত আবেদনকারী বিপ্লববাবুর আইনজীবী অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়কে বলেন, “আপনার কী বলার আছে বলুন।”

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, “সাংসদ তাপস পাল আদালতগ্রাহ্য অপরাধ করেছেন বলেই তাঁর মক্কেল মনে করেন। বিচারপতি দত্তের এজলাসে সাংসদের বক্তব্যের সিডি জমা দেওয়া হয়েছিল। ডিভিশন বেঞ্চেও সেই সিডি তিনি দাখিল করেছেন। আবেদনকারী পুলিশকে এফআইআর দায়ের করতে বলেছিলেন। পুলিশ তা করেনি।”

বিচারপতি গুপ্ত বলেন, “আদালতগ্রাহ্য অপরাধ না-হলে পুলিশ এফআইআর করবে না। আপনি আবেদনের নথি থেকে দেখান এখানে আদালতগ্রাহ্য অপরাধ কোথায়।”

এর পর তাপস যা যা বলেছেন, তা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে কি না, সেই মর্মে শুনানি এগোয়।

অনিরুদ্ধবাবু বলেন, “সাংসদ বলেছেন, তাঁর কাছে রিভলভার রয়েছে। তিনি গুলি করে দেবেন। বলছেন, তিনি এক জন গ্যাংস্টার। সাংসদের বক্তব্যে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শত্রুতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।”

বিচারপতি গুপ্ত বলেন, “সাংসদ লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিভলভার নিয়ে ঘুরলে সব সময় তা অপরাধ না-ও হতে পারে। মস্তান আর সাংসদ এক নন। নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি রিভলভার রাখতেই পারেন।”

বিচারপতির পরের মন্তব্য, “গুলি করে দেব বললেই অপরাধ হয় না। কেবলমাত্র অপরাধের ইচ্ছাপ্রকাশ করাই অপরাধ নয়।” বিচারপতি জানান, যে কোনও অপরাধের চারটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত অপরাধ করার ইচ্ছে, দ্বিতীয়ত অপরাধের প্রস্তুতি, তৃতীয়ত অপরাধের চেষ্টা, চতুর্থত অপরাধ ঘটানো। এ ক্ষেত্রে কেবল ইচ্ছে প্রকাশ হয়েছে। বিচারপতির কথায়, “কেউ যদি হামলা করে, তা হলে আমি গুলি করব’ বললে অপরাধ করা হল কি? আত্মরক্ষার্থে তিনি তা করতে পারেন।”

এর পরেই বিচারপতি বলেন, “নিজেকে গ্যাংস্টার বলে সাংসদ নিজেকেই কলুষিত করেছেন। তিনিই তাঁর বদনাম করেছেন। সেটা তো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না।”

এর পর আইনজীবী অনিরুদ্ধবাবু তাপসের বক্তৃতার ওই অংশটি উল্লেখ করেন, যেখানে তাপস ‘ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করানো’র হুমকি দিয়েছেন।

বিচারপতিও এখানে থমকে গিয়ে বক্তৃতার অংশটি পড়তে শুরু করেন।

অনিরুদ্ধবাবু এর পর বিচারপতিকে অনুরোধ করেন, ‘‘আপনি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ (ক) ধারাটি দেখুন। সাংসদ এখানে তাঁর অনুগামীদের অপরাধ করার জন্য প্ররোচিত করছেন। এটা আদালতগ্রাহ্য অপরাধ।”

বিচারপতি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটায় ফের শুনানি।

এ দিন সরকারি আইনজীবীর সওয়াল নিয়ে আইনজ্ঞ মহলে অনেকে অবশ্য নানা প্রশ্ন তুলেছেন। কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের ক্ষমতা রয়েছে, পুলিশকে এফআইআর দায়ের করতে বলার।”

সোমবার বিচারপতি দত্ত তাঁর নির্দেশে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করে বলেছিলেন, “অভিযোগ পাওয়ার পরেও এফআইআর দায়ের না করে পুলিশ প্রমাণ করেছে, হয় তারা ফৌজদারি আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, অথবা পরিকল্পতি ভাবেই তারা সাংসদকে বাঁচাতে চাইছে।” তাপস যা করেছেন, বিচারপতি তাকে ‘আদালতগ্রাহ্য অপরাধ’ বলেই মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, এক জন জনপ্রতিনিধি যখন তাঁর অনুগামীদের খুন-ধর্ষণ-হামলা করতে প্ররোচিত করেন এবং পুলিশ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে, সেটা জাতির পক্ষে বিপজ্জনক।

এ দিন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য দাবি করেন, “এক জন সাধারণ মানুষ আর এক জন জনপ্রতিনিধির ‘গুলি করে দেবো’ বলায় পার্থক্য রয়েছে। তিনি কথাটা বলেছেন, একটি সংগঠিত জমায়েতের সামনে। তার গুরুত্ব অন্য রকম।” তাঁর মতে, সাংসদের কাছে থাকা রিভলভারের লাইসেন্স রয়েছে কি না, সেটাও তদন্ত সাপেক্ষ।

সাংসদের হয়ে রাজ্য সরকার কেন মামলা লড়ছে, উঠেছে সে প্রশ্নও। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “তাপস পাল রাজ্য সরকারের আধিকারিক বা মন্ত্রী নন। তাঁকে আড়াল করতে কেন জনগণের করের টাকায় সরকার মামলা লড়ছে?” হাইকোর্টের আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “তাপস পালের আইনজীবী আপিল মামলা করতে পারেন। কিন্তু রাজ্য সরকার কোন লজ্জায় আপিল মামলা করল?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE