Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

এইচআইভি! যুবকের ঠাঁই হাসপাতালেই

পাড়ায় কেউ ডেকে কথা বলে না। যেচে কথা বলতে গেলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ঘরে পা পড়ে না বাইরের কারও। এমনকী, বাড়ির লোকজনও এড়িয়ে চলেন তাঁকে। অসুস্থ শরীরে নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে খেতে হয় বছর তিরিশের যুবককে।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও নির্মল বসু
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৪৩
Share: Save:

পাড়ায় কেউ ডেকে কথা বলে না। যেচে কথা বলতে গেলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ঘরে পা পড়ে না বাইরের কারও। এমনকী, বাড়ির লোকজনও এড়িয়ে চলেন তাঁকে। অসুস্থ শরীরে নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে খেতে হয় বছর তিরিশের যুবককে। জল নিতে বাড়ির কলে গিয়েও ঘাড় ধাক্কা খেতে হয়েছে আগে। একটা সময়ে আত্মীয়েরা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।

দীর্ঘ দিন ধরে ঘরে-বাইরে এমনই হেনস্থার শিকার হতে হতে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙছিল উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁর ওই যুবকের। তাঁর ‘অপরাধ’ একটাই, শরীরে এইচআইভি সংক্রমণ। আর সেটা জানাজানি হওয়াতেই এই বিপত্তি।

অভিযোগ, এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে না পেরে বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধেই ইদানীং ফুঁসে উঠেছিলেন যুবক। পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন নিকটাত্মীয়েরা। পুলিশ সোমবার থানায় নিয়ে আসে যুবককে। অসুস্থ, শীর্ণকায় যুবকের রাত কাটে সেখানেই।

এইচআইভি আক্রান্তদের সংগঠনের সহ সভাপতি শুক্লা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আগেও ছেলেটার উপরে মানসিক অত্যাচার হতো। পুলিশ ওকে ধরে সারা রাত থানায় বসিয়ে রেখে ঠিক করেনি।’’ জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘নিরাপত্তার কথা ভেবেই ওঁকে থানায় আনা হয়েছিল। গ্রেফতার করা হয়নি।’’

ঘটনার কথা জানতে পেরে মঙ্গলবার এইচআইভি আক্রান্ত্রদের সংগঠনের সদস্যেরা মিনাখাঁ থানায় যান। ওই যুবক ও তাঁর পরিবারকে বসিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান, পুলিশ আধিকারিকেরা বৈঠক করেন। কিন্তু যুবককে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে রাজি হননি আত্মীয়েরা। শেষে চিকিৎসার জন্য তাঁকে মিনাখাঁ হাসপাতালে নিয়ে যান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা।

যুবকের মা বলেন, ‘‘ইদানীং খেপে উঠে মারধর, ভাঙচুর শুরু করেছে ছেলে। বাধ্য হয়ে পুলিশ ডাকতে হয়েছিল।’’ ছেলে নিজেই এর আগে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল বলে দাবি বাবার।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এইচআইভি পজেটিভ হলেই এডস আক্রান্ত বলা যায় না। তা ছাড়া, কারও শরীরে যদি এই রোগ বাসা বাঁধে, তা হলেও তা ছোঁয়াচে নয়। রোগীর ব্যবহারের জিনিস ছুঁলে বা ঘরে গেলে কারও ওই সংক্রমণ ছড়ায় না। এ ধরনের রোগীকে একঘরে করাটা রীতিমতো সামাজিক অপরাধ। সরকারি স্তরে বহু টাকা খরচ এ নিয়ে সারা বছর প্রচার চলে। কিন্তু তা গাঁয়েগঞ্জের মানুষের মনে যে বিশেষ দাগ কাটতে পারেনি এখনও, মিনাখাঁর ঘটনা তা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

২০১১ সালে এইচআইভি সংক্রমণ ধরা পড়ে ওই যুবকের। পরিবার-পরিজনেরাও এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। বাড়ির নীচতলায় ঠাঁই হয় যুবকের। অযত্নে-অবহেলায়, একা থাকতে থাকতে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। যুবকের কথায়, ‘‘একঘরে করে তো রেখেইছিল। সোমবার ওরা আমাকে মারধর করে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেয়।’’

স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান মানছেন, এলাকার লোকজন মনে করেন, এডস ছোঁয়াচে রোগ। তাই কেউ কেউ ওই যুবককে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তা যে নেহাতই ভ্রান্ত ধারণা, তা নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে কী করছে পঞ্চায়েত? প্রধান বলেন, ‘‘ওঁর বাবা-মাকে বলা হয়েছে, ছেলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে। গ্রামে শিবির করে এইচআইভি ছোঁয়াচে নয় বলে প্রচার করা হবে।’’

আত্মীয়েরা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান না জেনে এর মধ্যে ভেঙে পড়েছেন যুবক। বললেন, ‘‘যে ক’টা দিন বাঁচি, একটু শান্তিতে থাকতে চাই।’’ তাঁর কাতর অনুরোধ, ‘‘আমাকে একটা থাকার জায়গা করে দিতে পারেন!’’

এডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থার প্রকল্প অধিকর্তা পৃথা সরকারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। ঘটনার কথা শুনে তিনি বলে দেন, ‘‘ব্যস্ত আছি।’’ ফোন কেটে যায়। পরে আর ফোন ধরেননি ‘ব্যস্ত’ আধিকারিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

HIV Outcasted Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE