Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

থানায় বধূ, শৌচাগারে হ্যাঁ শ্বশুরবাড়ির

শ্বশুরবাড়িতে একটা শৌচাগার চেয়ে বাড়ির বৌ শ্বশুর-শাশুড়িকে অনুরোধ করতে পারেন। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন। রাগ করে ‘বাপের বাড়ি চলে যাব’—এই হুঁশিয়ারিও দিতে পারেন।মধুমিতা মাহাতো এ সবই করেছিলেন।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪১
Share: Save:

শ্বশুরবাড়িতে একটা শৌচাগার চেয়ে বাড়ির বৌ শ্বশুর-শাশুড়িকে অনুরোধ করতে পারেন। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন। রাগ করে ‘বাপের বাড়ি চলে যাব’—এই হুঁশিয়ারিও দিতে পারেন।

মধুমিতা মাহাতো এ সবই করেছিলেন। কিন্তু, শৌচাগার হয়নি। তাই সটান থানায় চলে গেলেন তিনি! প্রথম দিকে অস্বস্তি হলেও পুরুলিয়ার ঝালদা থানার আইসি ত্রিগুণা রায়কে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলেন মধুমিতা। শুনে সেই পুলিশ অফিসারও থ! পণের দাবিতে নির্যাতন, মদ খেয়ে স্বামীর মারধর কিংবা শ্বশুরবাড়িতে বনিবনা না হওয়া— এমন কত সমস্যা নিয়েই বধূরা আসেন থানায় সুরাহার আশায়। তা বলে হাজার বার বলেও শ্বশুরবাড়ি শৌচাগার গড়ে দিচ্ছে না—এমন অভিযোগও শুনতে হবে, তা ভাবেননি আইসি। যেমন ভাবেননি, ঝালদা ১ ব্লকের মাহাতোমারা গ্রামে, মধুমিতার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। কখনও ভাবেননি, ‘হচ্ছে-হবে’ করে এত দিন যা নিয়ে তাঁরা টালবাহানা করছিলেন, তা এক শহুরে শিক্ষিত যুবতীর কাছে খুবই লজ্জার। মধুমিতা আর পিছিয়ে আসতে নারাজ। বলছেন, ‘‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শৌচালয় না হলে শ্বশুরবাড়িতে থাকা নয়।’’

চার বছর আগে মাহাতোমারা গ্রামের যুবক অশোক মাহাতোর সঙ্গে মোবাইলে মিস্ড কলের সূত্রে আলাপ ও পরে প্রেম মধুমিতার। তখন তিনি বহরমপুর কমার্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। অশোকের স্থায়ী কাজ ছিল না। ঠিকা সংস্থার অধীনে মাঝেমধ্যে কাজ করেন। পরিবারের চাষাবাদ রয়েছে। প্রত্যন্ত এক গ্রামে শ্বশুরবাড়ি জেনেও তা মেনে নিয়েছিলেন।

কিন্তু, বিয়ের সময় বহরমপুর শহরের ওই যুবতী ভাবতে পারেননি, শ্বশুরবাড়িতে শৌচাগারই নেই! সামান্য এক শৌচাগারের দাবি ক্রমেই রূপ নেয় পারিবারিক অশান্তির। এ ভাবে কেটেছে চার বছরেরও বেশি। তত দিনে দম্পতির মেয়ে হয়েছে। মধুমিতার শৌচাগারের দাবি আরও জোরালো হয়েছে। কিন্তু, কাজ হয়নি। রবিবার তাই কিছুটা মরিয়া হয়েই ঝালদা থানায় হাজির হন তিনি। আইসি শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ডেকে কথা বলেন।

মধুমিতার ক্ষোভ, ‘‘শ্বশুরবাড়ি গ্রামে, তা নিয়ে আক্ষেপ নেই। কিন্তু সম্ভ্রমের বিষয়টা কেন উপেক্ষিত হবে?’’ তিনি জানান, প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে জোড় (পুকুর) রয়েছে। সেখানে যেতে হয়। এটা দিন দিন তাঁর কাছে সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘শীত থেকেই এই সব অঞ্চলে জলকষ্ট শুরু হয়ে যায়। জোড়েও জল কমে আসছে। আমি টানা কয়েক দিন স্নান করতে পারিনি। কেন জানি না, এটুকু চাওয়াও উপেক্ষিত হচ্ছিল শ্বশুরবাড়িতে। তাই আর সহ্য করতে পারিনি। থানায় চলে এসেছি।’’ মধুমিতার মা চন্দনা হাজরাও গ্রামে এসে বলেন, ‘‘এক দিন ওই পুকুরে স্নান করতে গিয়েই দম বেরিয়ে গিয়েছে। মেয়েকে তো রোজ করতে হয়। ’’

মাহাতোমারা গ্রামে ৪৫টি পরিবার। শৌচালয় আছে মাত্র ১৪টি বাড়িতে। এই পরিসংখ্যান যে আশাব্যঞ্জক নয়, তা মেনে নিয়ে বি়ডিও (ঝালদা ১) পূর্ণদেব মালাকারের খেদ, স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখে অন্য গ্রামের বধূরাও এ ভাবে শ্বশুরবাড়ির কাছে শৌচাগার দাবি করলে প্রশাসনের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত। তাঁর কথায়, ‘‘নিজের সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে ওই বধূ যে ভাবে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে তাঁর পাশে দাঁড়াতে বলেছি।’’ অশোক নিজেও স্ত্রীর দাবি মানতে রাজি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে আমাদের বাড়িতে শৌচাগার নেই। আসলে ঠিক করেছিলাম, ঝালদা শহরে বাড়ি করে সেখানেই যা করার করব। যাই হোক, এ বার আমাদের গ্রামের বাড়িতেই দ্রুত শৌচাগার গড়ব।’’

কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। পুলিশে ছুঁলে ১০৮। তা হলে কি পুলিশের ভয়েই...? জানা যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

House Wife Toilet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE