Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

আমার খুব ভয় করছে: মদন

অনুচরদের সামনে এখনও ভেঙে পড়ছেন না তিনি। ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডের ২১ নম্বর কক্ষের ভিআইপি রোগীটি যে ভিতরে ভিতরে কতটা অস্থির, ডাক্তারদের কাছে তা লুকোনো থাকছে না। শোনা গিয়েছে, শুক্রবার সন্ধের দিকে ডাক্তারদের কাছে মন্ত্রী বলছেন, ‘‘আমার খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন গলা টিপে ধরতে আসছে।’’

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৯
Share: Save:

অনুচরদের সামনে এখনও ভেঙে পড়ছেন না তিনি। ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডের ২১ নম্বর কক্ষের ভিআইপি রোগীটি যে ভিতরে ভিতরে কতটা অস্থির, ডাক্তারদের কাছে তা লুকোনো থাকছে না।

শোনা গিয়েছে, শুক্রবার সন্ধের দিকে ডাক্তারদের কাছে মন্ত্রী বলছেন, ‘‘আমার খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন গলা টিপে ধরতে আসছে।’’ বারবার জানতে চাইছেন, সৃঞ্জয় বসু গ্রেফতার হয়ে কিছু বলে বসেছেন কি না!

তিনি মদন মিত্র। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি না-হলে শুক্রবারই তাঁর হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল বিধাননগরে সিবিআইয়ের দফতরে।

সিবিআইয়ের হাতে তাঁর দলের সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর গ্রেফতারির খবর বিকেলের মধ্যেই হাসপাতালের অন্দরে ঢুকে পড়েছে। কেবিন থেকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় এই নিয়ে প্রশ্ন শুনে মদনের আলতো জবাব, “মন্তব্য করব না। আমি এখন হাসপাতালের পেশেন্ট।”

মুখে যা-ই বলুন, ঘনিষ্ঠ মহলে কিন্তু সৃঞ্জয়কে নিয়ে উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারেননি মদন। কার্ডিওলজি বিভাগে ইকো-ডপলার পরীক্ষার পরে এ দিন সন্ধে ছ’টা নাগাদ কেবিনে ফেরেন তিনি। তারপর এ বিষয়ে বিশদ খোঁজখবর নেন। কী কারণে সৃঞ্জয়কে গ্রেফতার করা হল, জানতে চান। গ্রেফতারের আগে বা পরে সৃঞ্জয় বিবৃতি দিয়েছেন কি না, কয়েক জন পরিচিতকে তা-ও জিজ্ঞেস করেছেন মদন। সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের পরে বেরিয়ে কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র বা রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কী বললেন, সে কথাও জানতে চান তিনি।

পুজোর ঠিক আগে মন্ত্রীর দুই ঘনিষ্ঠ সহচরকে যখন সিবিআই ডাকে, তখন রীতিমতো ‘প্যানিক-অ্যাটাক’ হয়েছিল মদনবাবুর। সে বার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পিঠের টিউমারের চিকিৎসায় এ যাত্রাও প্রথমে সেই হাসপাতালেই গিয়েছিলেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রী ফোন করে তাঁকে ভরসা জোগানোয় খানিকটা অক্সিজেনও পেয়েছিলেন তিনি। আবার দলীয় নির্দেশেই আগের দিন হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়ে এসএসকেএমে এসেছেন।

তৃণমূল সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শেই সিবিআই জেরা এড়াতে বা যত দিন সম্ভব ঠেকিয়ে রাখতে রাতারাতি সরকারি হাসপাতালের ‘আশ্রয়ে’ আনা হয়েছে মন্ত্রীকে। কর্মী ইউনিয়নের সঙ্গে যোগসূত্রে এই হাসপাতালের নাড়িনক্ষত্র তাঁর চেনা। এই স্বাচ্ছন্দ্যের আবহেও মন্ত্রীর স্বভাবসিদ্ধ বৈঠকী মেজাজে এ দিন বারে বারে তাল কেটেছে। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, এ দিন একবারও দলনেত্রীর ফোন আসেনি মদনের কাছে। ঘরোয়া আলোচনায় মমতা-প্রসঙ্গ উঠলেও আড়ষ্ট ছিলেন মদন। কেউ তাঁকে বলেন, কল্যাণীতে দলের কর্মিসভায় তৃণমূল নেত্রী তাঁর নাম করেছেন। বলেছেন অটো চালকদের বিমাভুক্ত করার জন্য তিনি মদনকে বলবেন। পরিবহণমন্ত্রী জবাব দেন, ‘‘এই নিয়ে কথা বলব না।’’

সিবিআইয়ের প্রসঙ্গ উঠলে ওপর ওপর স্বাভাবিক থাকারই চেষ্টা করছেন এখনও। ঘনিষ্ঠমহলে এ-ও বলেছেন, হাসপাতাল থেকে তিন ঘণ্টার ছুটি পেলেই তিনি সিবিআইয়ের দফতরে ঘুরে আসবেন। সিবিআই-এর একটি সূত্রও বলছে, পরিবহণমন্ত্রী আইনজীবী মারফত তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন শীঘ্রই সুস্থ হয়ে তিনি দেখা করতে যাবেন। তবে ক’দিন আগে বুক ঠুকে সিবিআইকে হাসপাতালে জেরার জন্য আমন্ত্রণ জানানোর সময়ে যে জঙ্গি মেজাজ ছিল, তা এ দিন উধাও।

তবে এর পিছনে মদনের শারীরিক অবস্থাও একটা বড় কারণ বলে দাবি করছেন তাঁর পরিজনেদের একাংশ। দুপুরের পর থেকে মন্ত্রীর শ্বাসকষ্ট বেড়েছে বলে জানিয়েছেন মেডিক্যাল বোর্ডে থাকা এক চিকিৎসকও। এই উপসর্গের পিছনে কোনও চাপা টেনশন কাজ করছে বলে তাঁর অভিমত। সে কারণে এ দিন মন্ত্রীকে ঘুমের ওষুধের পাশাপাশি স্নায়ুর উত্তেজনা কমানোর ওষুধও দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী মানসিক ভাবে শান্ত না হলে চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া মুশকিল বলে ডাক্তাররা মনে করছেন।

বিকেলে স্ত্রী, পুত্রেরা তাঁকে দেখতে এলে মদন কিছুটা অনুযোগের সুরেই জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ খাবার খেয়েছিলেন। তার পরে প্রায় ২০ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য তিনি শক্ত খাবারই খাননি। বলেন, “৫-৬ কাপ গ্রিন টি ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি সারাদিনে। আমার মাথা ঘুরছে!”

সকালের দিকটা মদনবাবু তুলনায় স্বাভাবিক ছিলেন বলে জানাচ্ছেন ডাক্তারেরা। উডবার্নের ২০ নম্বর কেবিনের শৌচাগারের পাইপ লাইনে কিছু সমস্যা থাকায় তাঁকে তখনই ২১ নম্বর কেবিনে স্থানান্তরত করা হয়। বেলা খানিক বাড়তেই মদনের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। বিকেল ৪টে নাগাদ আলট্রাসনোগ্রাফির জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। তখনও সৃঞ্জয়কে গ্রেফতারের খবর আসেনি। তার কিছুক্ষণ পরেই মন্ত্রী খবরটা পান।

এসএসকেএম সূত্রে জানা গিয়েছে, চিকিৎসকদের কাছে বারবার ভয় পাওয়ার কথা বলছেন মন্ত্রী। সেটা মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যদের যথেষ্ট চিন্তায় ফেলেছে। মদনবাবুর জন্য গঠিত সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডে রয়েছেন শল্যবিশারদ বিতান চট্টোপাধ্যায়, কার্ডিওলজির শিবানন্দ দত্ত, এন্ডোক্রিনোলজির শুভঙ্কর চৌধুরী, মেডিসিন-এর নির্মলেন্দু সরকার, চেস্ট-এর সোমনাথ কুন্ডু, ইএনটি-র অরুণাভ সেনগুপ্ত এবং সাইকিয়াট্রির প্রদীপ সাহা। পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি, টিউমারের বায়োপসির পাশাপাশি ইকো কার্ডিওগ্রাম, ডপলার টেস্ট, এমআরআই, সিটি স্ক্যান-সহ মদনবাবুর বেশ কিছু রক্ত পরীক্ষাও করতে বলেছে মেডিক্যাল বোর্ড। সেই মতো এ দিনই অ্যাম্বুল্যান্সে চড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁর আলট্রাসনোগ্রাফি, ইকো কার্ডিওগ্রাম, ডপলার টেস্ট-সহ কিছু পরীক্ষা করা হয়।

মেডিক্যাল বোর্ডের এক সদস্য বলেন, “এমনিতেই ওঁর সিওপিডি (ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের সমস্যা) রয়েছে। তার উপরে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া (ঘুমের মধ্যে দম আটকে আসা)। এই অবস্থায় যদি এত আতঙ্ক তৈরি হয়, তা হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE