হিন্দি বলয়ে কথিত রয়েছে, রাজনীতির দ্বৈরথে স্নায়ু ধরে রাখাটা ‘শ’বাতকি এক বাত!’ এবং সেই লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ার অর্থ যুদ্ধে অর্ধেক পিছিয়ে পড়া!
বেআইনি লগ্নি কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তকে পুঁজি করে বিজেপি যখন বাংলার শাসক দলকে প্রবল চাপে ফেলতে চাইছে, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার বুঝিয়ে দিলেন, সে গুড়ে বালি! প্রতিহিংসার কৌশলে দমানো যাবে না তাঁকে। বরং মানুষকে নোট-ধাক্কা দেওয়া থেকে শুরু করে বদলার রাজনীতি মোদীকেই ডুবিয়ে ছাড়বে।
এ দিন বীরভূমের কেন্দুলিতে বাউল উৎসবের সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘নোটবন্দি নিয়ে মমতা ব্যানার্জি বলছে বলে তৃণমূলের সবাইকে গ্রেফতার করতে হবে! কিছু যায় আসে না মোদী! মমতারাই থাকবে, তুমি থাকবে না!’’ সেই সঙ্গে তাঁর স্বভাব সুলভ কটাক্ষে ছড়া কেটে বলেন, ‘‘চলবে না অন্যায়, টিকবে না ফন্দি। জনগণের আদালতে হতে হবে বন্দি!’’
বস্তুত মোদী সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মমতা যে প্রতিবাদে নেমেছিলেন, তা এখন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সংঘাতে পর্যবসিত হয়েছে। জাতীয় স্তরে মোদী-বিরোধী বাতাবরণ মজবুত করার লক্ষ্যে তৃণমূল নেত্রী যেমন বিরোধী ঐক্য গড়তে অনুঘটকের ভূমিকায় নেমেছেন। তেমনই সিবিআই তদন্তকে হাতিয়ার করে তৃণমূলের মাজা ভাঙার চেষ্টায় নেমেছে বিজেপিও। তৃণমূলের একাধিক প্রথম সারির নেতা স্বীকার করছেন, দ্বৈরথের এমন চেহারা দেখে ভিতরে ভিতরে টলে গিয়েছেন দলের কিছু তাবড় নেতাও। কিন্তু মমতা পোড় খাওয়া রাজনীতিক। দলে তাঁর ঘনিষ্ঠদের মতে— দিদি বুঝতে পারছেন, এই খেলায় এতটুকু মানসিক দুর্বলতা দেখানো মানেই হেরে ছিটকে যাওয়া। উল্টে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বিজেপিকে বুঝে নিতে হবে। বিজেপি ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে সিবিআইকে ব্যবহার করলে, পাল্টা হুমকি দিতে হবে, ‘‘আমাদেরও আইন আছে, পুলিশ আছে, গ্রেফতার আমরাও করতে পারি।’’
তৃণমূল নেতৃত্বের কথায়— নেত্রী দলে যেমন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, দমে গেলে চলবে না। তেমনই এখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও এই বার্তা দিতে নেমেছেন যে চক্রান্তের ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া তাঁর অভিধানে নেই। তাই নিয়ম করে রোজ তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছেন তো বটেই, গোটা দলকেও রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। এমনকী সিবিআই তদন্তকে নিখাদ ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ বলে মানুষের মনে ধারণা গেঁথে দিতে ভুবনেশ্বরে খোদ সিবিআই দফতরের অদূরে এ দিন সভা করিয়েছেন সুব্রত বক্সী-মানস ভুঁইয়া-বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়দের দিয়ে। তা ছাড়া পঞ্জাবের অমৃতসরে গিয়ে এ-দিনই নোট বাতিলের প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়। আবার কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আঞ্চলিক দফতরের দোরগোড়ায় মঙ্গলবারও সভা করেছেন পার্থ ও শোভন চট্টোপাধ্যায়রা।
তবে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিযোগ তুললেও মমতা এ দিন জানান সিবিআই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। সোমবারই তিনি সিবিআইকে ‘কনস্পিরেসি ব্যুরো’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘সিবিআইকে আমরা শ্রদ্ধা করি। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু কয়েকটা লোককে বসিয়েছে মোদী, একদম চক্রান্তকারী দালাল এগুলো। তাদের কাজ কী? মমতা ব্যানার্জি মানুষের কথা বলছে, ওকে চোর বলো! সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চোর বল! তাপস পালকে চোর বলো!’’
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই বিজেপির পাশাপাশি লগ্নি কেলেঙ্কারি নিয়ে এ দিন বামেদের বিরুদ্ধেও আক্রমণাত্মক হয়েছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তৃণমূল আমলে একটাও ‘চিট ফান্ড’ হয়নি। সব হয়েছে সিপিএমের আমলে। তখন কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বিজেপির নেতারা সহারা-সহ নানা সংস্থায় জড়িত হলেও কাউকে ধরা হয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘সিপিএম আর বিজেপি হচ্ছে বিষদাঁত! এই দু’টো বিষদাঁতকে ভেঙে দিতে হবে। গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে, আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে।’’
শুধু মুখে বলা নয়, সিপিএমের সঙ্গে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার যোগসাজশ দেখিয়ে এ দিন থেকে কলকাতায় পোস্টারও ফেলেছে তৃণমূল। চিট ফান্ড কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে পোস্টারে কংগ্রেসের কিছু নেতার নামও রাখা হয়েছে। এ সব দেখে বিরোধী শিবিরের নেতারা অবশ্য মনে করছেন, এর পিছনেও মমতার সুচিন্তিত কৌশল রয়েছে। সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘ওঁরা আসলে নিজেদের আড়াল করার জন্য দেখাতে চান— শুধু ওঁরা নন, সকলেই চোর!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy