ব্যারাকপুর আদালতে অনুকূল মাইতি। — নিজস্ব চিত্র।
সাবধানবাণী এসেছিল ‘সিকিওরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড ইন্ডিয়া’ বা সেবি-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছ থেকে। মানুষকে সতর্ক করে দেওয়ার দায় ছিল রাজ্য পুলিশের। কিন্তু বিভিন্ন অর্থ লগ্নি সংস্থা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ঢালাও টাকা তুললেও তখন তাদের সক্রিয় হতে দেখা যায়নি।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি যখন ওই সব অর্থ লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে, ধরপাকড় চালাচ্ছে, তখনই সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেল সেই রাজ্য পুলিশকেও।
বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার তালিকার শীর্ষে থাকা আইকোর-এর মালিক অনুকূল মাইতিকে বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ সিআইডি। ব্যারাকপুর আদালত তাঁকে ১১ দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আইকোর তো বটেই, সেই সঙ্গে ওই সংস্থার অধীনে আরও ১৯টি কোম্পানি সেবি-র অনুমতি ছাড়াই মাল্টি ইনভেস্টমেন্ট সিস্টেম, ডিবেঞ্চার, ফিক্স ডিপোজিট-সহ নানান ব্যবস্থায় আমানতকারীদের কাছ থেকে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা তুলেছে বলে অভিযোগ।
আইকোর-কর্ণধারকে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে ডিআইজি (সিআইডি) দিলীপ আদক জানান, গত জুনে এক আমানতকারী বেলঘরিয়া থানায় ওই সংস্থার বিরুদ্ধে ছ’লক্ষ টাকার প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেন। নভেম্বরে তদন্তে নামে সিআইডি। জানা যায়, আইকোর ই-সার্ভিসের নামে ওই আমানতকারীর কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা তোলা হয়েছে। আইকোরের নামে যত সংস্থা রয়েছে, সব ক’টিরই ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা এমডি অনুকূল মাইতি। তাঁর এজেন্টের সংখ্যা ১৭ হাজার। নিজের স্ত্রী ছাড়াও ১২ জন ডিরেক্টর আছেন তাঁর সংস্থায়। সকলেই পলাতক বলে জানিয়েছে সিআইডি। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এ দিন সকালে অনুকূলের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকেও গ্রেফতার করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সিআইডি পৌঁছোনর আগেই স্ত্রী বেরিয়ে যান। তিনি আর ফিরে আসেননি।
সিআইডি জানাচ্ছে, আইকোরের কর্মপদ্ধতি অর্থাৎ লোক ঠকানোর কায়দা আর-পাঁচটা বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার মতোই। মিল রয়েছে টাকা সরানোর পন্থাতেও। সারদা ও রোজ ভ্যালি তাদের ব্যবসা ছড়িয়েছে অন্যান্য রাজ্যেও। আইকোর-ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরাতেও ডালপালা ছড়িয়েছে। সারদা-রোজ ভ্যালির মতোই একটি সংস্থার অধীনে বেশ কয়েকটি সংস্থা তৈরি করে রেখেছিল আইকোর। গোয়েন্দারা তদন্তে দেখেছেন, আইকোরের মোট ১৯টি কোম্পানির মধ্যে চারটির রেজিস্ট্রি বা নথিভুক্তই করা হয়নি। ওই সব কোম্পানি সেবি-র কাছ থেকে কোনও অনুমতি না-নিয়েই বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে টাকা তুলছিল।
সিআইডি-র চোখে অনুকূলের উত্থানও অনেকটা সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন এবং রোজ ভ্যালির মালিক গৌতম কুণ্ডুর মতো। ওঁদের সকলেই প্রথম জীবনে অভাব-অনটন, অর্থকষ্ট দেখেছেন। মাঠেঘাটে ঘুরে, ঘাম ঝরিয়ে কাজ করেছেন। ধীরে ধীরে বাড়িয়েছেন সাম্রাজ্য। ২০০৫ সাল পর্যন্ত অনুকূল ছিলেন একটি নামী বিমা সংস্থার এজেন্ট। ২০০৭ সালে তিনি তৈরি করেন আইকোর। এক সিআইডি-কর্তা জানান, সারদা-রোজ ভ্যালির মতো আইকোরের সঙ্গেও বেশ কিছু প্রভাবশালী ও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের যোগ ছিল। ওই সংস্থার দৈনন্দিন কার্যকলাপে তাঁদের কোনও ভূমিকা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআইকে তদন্তভার দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট অন্যান্য লগ্নি সংস্থার ব্যাপারেও তাদের তদন্ত করতে বলেছিল। নির্দেশ দিয়েছিল, সারদার টাকায় কোন কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি লাভবান হয়েছেন, সেটাও যাচাই করতে হবে। আইকোরের সঙ্গে যুক্ত নামী লোকেরা তাদের তদন্তের আওতায় আসেন কি না, এ বার সেটাই দেখার।
সারদার তদন্তে নেমে রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে তাঁদের আড়াল করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। আইকোরের মালিককে গারদে পুরে সিআইডি কিছুটা তৎপরতার প্রমাণ দিল। এ দিন দুপুরে পুলিশের সুমো গাড়িতে বছর পঞ্চাশের অনুকুলকে ব্যারাকপুর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর পরনে ছিল লাল চেক শার্ট ও কালচে প্যান্ট। তাঁকে কিছু ক্ষণ কোর্টের লক-আপে রেখে এসিজেএম দেবকুমার সুকুলের এজলাসে তোলা হয়। এজলাসের লক-আপে লোহার জাল ধরে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনুকুল। তাঁর আইনজীবী অরিন্দম ঘোষ আদালতে জানান, মেগামোল্ড ও প্রোমোটেক নামে অনুকুলের আরও দু’টি সংস্থা রয়েছে। সেবি নির্দেশ দিয়েছে, ওই সংস্থা দু’টি বিক্রি করে সেই টাকায় আইকোরের গ্রাহকদের পাওনা মেটাতে হবে। এই কাজের জন্য কিছু সময় দেওয়া হোক। সরকারি আইনজীবী শঙ্করদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সেবি এই নির্দেশ দিয়েছে অনেক আগেই। সেই সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে।
দু’পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পরে ধৃতকে জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেয় আদালত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy