ফাঁকা শ্রেণিকক্ষ। ফাইল চিত্র
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে আমরা জেনেছি যে কলকাতায় ৫৩২টি সরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭৫টি বিদ্যালয় এ বছরই বন্ধ হচ্ছে। ২০১৮ তে এই বিদ্যালয়গুলি থেকে শেষবারের মতো কিছু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে। পরের বছরও একই ভাবে বন্ধ হবে ৫০টি বিদ্যালয়। সুতরাং আগামী দু’বছরের মধ্যে কলকাতার ২৪ শতাংশ বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উল্টো দিকে বেড়ে চলছে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলের সংখ্যা। একটি সমীক্ষা অনুমান করছে, আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে দেশের সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি পড়ুয়ার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সে জায়গা নেবে বেসরকারি স্কুল।
প্রশ্ন উঠতে পারে সরকারি বা সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত স্কুলে পড়ুয়াসংখ্যা কমার জন্য কেবল শিক্ষক-শিক্ষিকারাই কি দায়ী! তাঁরা কি শ্রেণিকক্ষে যথেষ্ট আন্তরিক নন? আবার সরকারি স্কুলে পড়ুয়া কমা ঠেকাতে সরকারি নজরদার সংস্থারা কী করছে, বিদ্যালয় পরিদর্শন কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইত্যাদি বিষয়েও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
সমীক্ষা জানাচ্ছে, বিদ্যালয়ের ৯২ শতাংশ পড়ুয়া গৃহশিক্ষক নির্ভর। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাকি আট শতাংশ পড়ুয়া পড়াশোনা চালানোর জন্য বাড়ির লোকজনের উপরে নির্ভরশীল। দশম শ্রেণির এক জন পড়ুয়ার অভিভাবককে প্রতি মাসে গড়ে তিন হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে গৃহশিক্ষকদের পারিশ্রমিক দিতে। এ রকম অনেক পরিবার রয়েছে, যাদের মাসিক আয়ের শতকরা ষাট ভাগ চলে যাচ্ছে এই খরচ যোগাতে। সরকার বই-খাতা ব্যাগ— সবই দিচ্ছে, তবু শিক্ষা আজ সে অর্থে অবৈতনিক থাকছে না।
গৃহশিক্ষকের উপরে নির্ভর করেই পার হয়ে যাওয়া যাবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের বৈতরণি — এই বিশ্বাস এক দিনে গড়ে ওঠেনি। যাঁরা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তাঁদের এ বার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ২০১০-এ সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে তা চালু হয় ২০১২ সালে। উদ্দেশ্য, শিশুদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। সরকারি স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সচেতন অভিভাবক যাঁরা সন্তানদের সময় দেন, বা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে সমান্তরাল বিকল্প ব্যবস্থা (গৃহশিক্ষক) নিতে পারেন, তাঁরা ছাড়া, বাকিদের ক্ষেত্রে শিক্ষার মান গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। কিছু ছাত্রছাত্রীর মনে এমনও ধারণা তৈরি হয়েছে, যে না পড়েই অষ্টম শ্রেণি পাশের শংসাপত্র পাওয়া যায়। কারণ, ন’শোর মধ্যে সব মিলিয়ে ২০ নম্বর পেলেও নবম শ্রেণিতে ওঠা যায়। পাশ-ফেলহীন শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকেরই থাকছে না পড়ার তাগিদ।
এ জন্য দায়ী সেই শিক্ষা ব্যবস্থা, যা জন্ম দিয়েছে ‘শিক্ষা-ব্যবসা’র। এখন কেবল গৃহশিক্ষকতা করেই অনেকে জীবনধারণ করছেন। স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ যত্ন করে পড়ালেও, সে পড়াশোনার গুরুত্ব ছাত্রছাত্রীদের অনেকের কাছে ক্রমশ কমছে। তাদের ধারণা, বাড়ির শিক্ষক বা শিক্ষিকা তাদের বিষয়টি ‘বেশি ভাল’ করে বোঝাবেন। সে জন্য ‘অমুক স্যার’-এর কোচিংয়ে ৫০ জনের ব্যাচে নাম লেখাতেও আপত্তি নেই তাদের অনেকের।
তাই ছাত্রছাত্রীদের স্কুলশিক্ষামুখী করে তুলতে প্রয়োজন নানা পদক্ষেপের। পড়াশোনার পাশাপাশি, অন্য দিকেও নজর দিতে হবে। টিফিন-সহ মিড-ডে মিল পরিষেবাকে উন্নত করতে হবে। প্রয়োজন পর্যাপ্ত খেলাধূলার বন্দোবস্তের। পড়ুয়া-শিক্ষক অনুপাত ৩০:১ এর নীচে নামিয়ে আনতে হবে। এক জনের অবসরের পরদিনই যাতে শূন্য পদে শিক্ষক বা শিক্ষিকা পাওয়া যায়, সে জন্য ঠিকঠাক নীতি প্রণয়ন করতে হবে ও তা বাস্তবায়িত করতে হবে। জোর দিতে হবে পড়ুয়াদের উপস্থিতিতেও। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে বসার জন্য ফর্ম পূরণের সময় পড়ুয়াদের ৭৫ শতাংশ উপস্থিতির বিষয়টি স্কুল কর্ত়়ৃপক্ষের তরফে সততার সঙ্গে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসার গুরুত্ব বুঝবে।
বেসরকারি স্কুলগুলোর মতো পরিকাঠামো তৈরি করতে গেলে সরকারি স্কুলের ফি বাড়াতে হবে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পড়ুয়া স্কুলছুট হওয়ার পিছনে অর্থাভাবই একমাত্র কারণ নয়। তবে প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া যেতে পারে। বর্ধিত ফি স্কুলের শিক্ষণ পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বেসরকারি স্কুলগুলির সঙ্গে পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে পাল্লা দিতে গেলে সরকারি স্কুলগুলোর পরিকাঠামো এবং শিক্ষণ পদ্ধতির খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে। সরকারি স্কুলে পড়ানোর সময়ে কম্পিউটার ও ‘প্রোজেক্টর’-এর ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। এতে পড়াশোনা অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। পড়ুয়ারা যাতে কম্পিউটারের ব্যবহারে সাবলীল হয়ে উঠতে পারে, নজর রাখতে হবে সে দিকে। সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এতে ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বাড়বে।
বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির কাঠামোতেও রদবদল করা প্রয়োজন। পরিচালন সমিতির সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হওয়া উচিত পড়ুয়া-সংখ্যা অনুসারে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রতি শ্রেণির প্রতি ‘সেকশন’ থেকে অন্তত এক জন অভিভাবক পরিচালন সমিতিতে থাকতে পারেন। এতে প্রতিটা সেকশনের অভাব-অভিযোগের কথা উঠে আসবে পরিচালন সমিতির বৈঠকগুলিতে।
এখনকার যুগে নোটবইয়ের যে রমরমা বেড়েছে, সেটা কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ করা যেতে পারে। নোটবই মানেই যে খারাপ, বিষয়টা তেমন নয়। সরকার পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি, সহায়ক বই ছাপিয়ে পড়ুয়াদের দিতে পারে। তাতে বাজার চলতি নোটবইয়ের রমরমা কমবে অনেকাংশে।
সমাজের সর্বস্তরে কৃতকার্য-অকৃতকার্যের মাপকাঠিটি থাকলেও শিক্ষায় কেন থাকবে না— সে প্রশ্নও তোলা উচিত। প্রয়োজন প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ-ফেল প্রথা ফিরিয়ে আনা। সরকারি স্কুলকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপ্রতীপে টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রশাসন ও অভিভাবকদের একযোগে কাজ করতে হবে।
লেখক কালনা মহারাজা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy