Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

দামি খাটে রোগী ছটফট, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ডাক্তার কই?

পেটে অসহ্য ব্যথা দেবী মাহাতোর। বারবার বমি হচ্ছে। ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের ততোধিক ঝকঝকে খাটে শোয়া ৫৫ বছরের দেবীর হাতে স্যালাইনের নল। নড়াচড়ার সাধ্য নেই তাঁর। বারবার আকুতি সত্ত্বেও ভর্তির পর ৩৬ ঘণ্টায় কোনও ডাক্তার আসেননি।

নয়াগ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

নয়াগ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪৩
Share: Save:

পেটে অসহ্য ব্যথা দেবী মাহাতোর। বারবার বমি হচ্ছে। ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের ততোধিক ঝকঝকে খাটে শোয়া ৫৫ বছরের দেবীর হাতে স্যালাইনের নল। নড়াচড়ার সাধ্য নেই তাঁর। বারবার আকুতি সত্ত্বেও ভর্তির পর ৩৬ ঘণ্টায় কোনও ডাক্তার আসেননি।

বিশাল ওয়ার্ডে মাত্র তিন জন রোগী। দেবীর অদূরেই একটি খাটে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক। সিভিক পুলিশ রাস্তা থেকে ধরে এনে ভর্তি করে গিয়েছে। হাত-পা ছুড়ছেন, চিৎকার করছেন তিনি। ঠোঁটের কোণ বেয়ে ফেনা।

ইনি এখানে কেন? একই ওয়ার্ডে পুরুষ আর মহিলা রোগীই বা কেন? বাইরের ঘরে বসে নার্স বললেন, ‘‘আর কী করা যাবে? এক ঘরে সবাই থাকলে তবু খানিকটা নজরে রাখা যায়। অন্য ঘরে পাহারা দেবে কে?’’ সিঁটিয়ে থাকা দেবী মাহাতো যন্ত্রণায় নিজের পেট খামচে ধরছেন। কী চিকিৎসা হচ্ছে ওঁর? খাতা দেখে নার্স জানালেন, স্টকে স্যালাইন আছে অঢেল। সেটা দেওয়া হচ্ছে। দরকারে আরও দেওয়া হবে। সঙ্গে ব্যথা কমানোর দু’টো ট্যাবলেট, দু’বেলা। ব্যস্। রোগটা কী, তা জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা দরকার। দরকার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি। কিন্তু সে জন্য যেতে হবে ৯০ কিলোমিটার দূরের জেলা হাসপাতালে। এখানে কিছু হবে না। ‘‘পেশেন্ট পার্টিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে’’— বললেন নার্স।

কোনও গ্রামীণ হাসপাতাল নয়। এটি পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রাম সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ছবি। স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন, হাঁড়ির একটা চাল টিপলে যেমন বোঝা যায় ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না, তেমনই এই একটা হাসপাতালের ছবিই প্রমাণ করে দিচ্ছে, স্বপ্নের সুপার স্পেশ্যালিটি তকমা এই মুহূর্তে কতটা বাস্তব হয়ে উঠতে পেরেছে এ রাজ্যে।

তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরানোর অন্যতম নজির হিসেবে বারবার তুলে ধরা হচ্ছে এই হাসপাতালগুলিকেই। এত দিন শুধু কয়েকটা আউটডোর চলছিল। মাস দেড়েক আগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরক্তি প্রকাশ করে জানতে চান, কেন ইন্ডোর চালু করা যাচ্ছে না? তার পরই তড়িঘড়ি ইন্ডোর পরিষেবা অর্থাৎ রোগী ভর্তি করা শুরু হয় কয়েকটি হাসপাতালে। নয়াগ্রাম তারই অন্যতম। পাশাপাশি বাঁকুড়ার বড়জোড়া, ছাতনা, পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালেও চালু হয়েছে ইন্ডোর।

এই চালু হওয়াটাই যেন কার্যত নিয়মরক্ষা! একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, ইউরোলজি, নেফ্রোলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, অর্থোপেডিক, জেনারেল সার্জারি, আই, ইএনটি ইত্যাদি বিভাগ থাকার কথা। থাকার কথা রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় আধুনিক ব্যবস্থা। ইন্ডোর চালু হওয়া এই হাসপাতালগুলিতে কী আছে?

ঘুরে দেখা গেল, প্রত্যেকটি হাসপাতালেরই বাড়িটি দুর্দান্ত। মেঝের মার্বেল কিংবা ওয়ার্ডের খাট-আলমারি কলকাতার কর্পোরেট হাসপাতালকেও হার মানায়। আলট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন রয়েছে, রয়েছে এক্স-রে মেশিনও। সব বাক্সবন্দি হয়ে। কারণ সেগুলি চালানোর কোনও লোক নেই! সাধারণ রক্ত পরীক্ষা, মল-মূত্র বা থুতু পরীক্ষাও হয় না এখানে। প্রসব হয় ঠিকই, কিন্তু সিজারিয়ানের সম্ভাবনা আছে বুঝলেই রেফার করে দেওয়া হয় জেলা হাসপাতালে বা নিকটস্থ মেডিক্যাল কলেজে। নবজাতকের সামান্য সমস্যা থাকলে তাকেও রেফার। সেই রেফারের জায়গা যদি ১০০ কিলোমিটারেও বেশি দূরে হয়, তা-ও সই।

কর্মীরাই স্বীকার করছেন, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল আদতে এক নেই-রাজ্য। অ্যানাস্থেটিস্ট নেই। সার্জারি বিভাগ খোলা হয়েছে, কিন্তু সার্জন নেই। নিওন্যাটাল বিভাগ রয়েছে, কিন্তু নিওন্যাটোলজিস্ট কিংবা পেডিয়াট্রিশিয়ান নেই। কার্ডিওলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট বা নেফ্রোলজিস্ট তো দূর অস্ত্, সাধারণ প্রসব আর জ্বর-পেট খারাপের চিকিৎসা ছাড়া কিছুই হয় না এখানে। এমনকী দুর্ঘটনায় চোট নিয়ে ইমার্জেন্সিতে এলেও পত্রপাঠ অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিক কিংবা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চেয়ে বাড়তি কোনও পরিষেবাই পাওয়া যায় না। বড়জোড়ার হাসপাতালে মেডিসিন, ইএনটি, চোখের ডাক্তার মিলিয়ে সেখানে ডাক্তারের মোট সংখ্যা ১৪। ১০০ শয্যার হাসপাতাল মাত্র ১৪ জন ডাক্তার দিয়ে চলছে কী ভাবে? চলাটা আদৌ যে সম্ভব নয়, তা মেনে নিয়ে কর্তৃপক্ষই জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ সময়ে হাসপাতাল ডাক্তারশূন্য হয়ে পড়ে থাকে। বড়জোড়ার এই হাসপাতাল তো প্রথম বার জীবাণু পরীক্ষাতেও পাশ করেনি। উতরেছে দ্বিতীয় বারে।

পাঁশকুড়ায় আবার ডাক্তার-নার্সের পাশাপাশি চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর অভাবও ভয়াবহ। চিকিৎসা তো দূরের কথা, হাসপাতাল বাড়িটা সাফসুতরো করার লোকও নেই। গোপীবল্লভপুরে প্রসব ছাড়া প্রায় আর কিছুই হয় না। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে এক কর্মীকে ধার করে আনা হয়েছে। তিনি ম্যালেরিয়া আর ব্লাড সুগারের রক্তপরীক্ষা করেন। তার বাইরে যা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার, যেতে হয় ৪৪ কিলোমিটার দূরের ঝাড়গ্রামে।

এই যদি পরিষেবার নমুনা হয়, তা হলে এই হাসপাতালগুলি চালু করার অর্থ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলার হয়তো জায়গা নেই। কিন্তু পরিকল্পনা না করে এত বড় একটা প্রকল্পে হাত দেওয়া হল কেন, সে প্রশ্ন উঠছেই।

এই হাসপাতালগুলির রূপায়ণের দায়িত্ব যাঁর উপরে, সেই স্বাস্থ্যকর্তা প্রদীপ মিত্র দাবি করেছেন, যে কোনও নতুন প্রকল্পে সমস্যা হতেই পারে। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য জুড়েই তো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব। টেকনিশিয়ানের অভাব। আমরা তার মধ্যেও নিয়োগ শুরু করেছি। এক দিনে হবে না। ধাপে ধাপে সব ঠিক হবে।’’ ছাতনার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এক রোগী। হাল হকিকত জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘‘ব্লক হাসপাতালে খাট জুটত না। ভর্তি হলে মাটিতে শুতে হতো। এখানে দামী খাট পাচ্ছি। দু’দিন জিরিয়ে যাব।’’

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

super speciality hospital doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE