Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘জীবন নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলব না’, ওঝারাই বাতলাচ্ছে হাসপাতালের রাস্তা!

কাদা জলে মাখামাখি শরীরটা আড়াআড়ি পড়ে রয়েছে উঠোনে। ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা, আধ-বোজা চোখ। পায়ের কাছে বসে অনর্গল মাথা চাপড়ে চলেছেন মাঝবয়সী মহিলা— ‘‘ও ডাক্তার, অবহেলা কোরোনি, একবার মন্তরটি পড়ে দাও!’’

রাহুল রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৪
Share: Save:

কাদা জলে মাখামাখি শরীরটা আড়াআড়ি পড়ে রয়েছে উঠোনে।

ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা, আধ-বোজা চোখ। পায়ের কাছে বসে অনর্গল মাথা চাপড়ে চলেছেন মাঝবয়সী মহিলা— ‘‘ও ডাক্তার, অবহেলা কোরোনি, একবার মন্তরটি পড়ে দাও!’’ সেই লাক্সবাগান থেকে নদী উজিয়ে আনা হল ‘সাপে কাটা’ রোগীকে, আর হাজারি ওঝা কিনা গোঁ ধরে বসল, রোগী দেখব না!

সুন্দরবনের রাঙাবেলিয়া থেকে লাহিড়িপুর— নালা-নদীর আঁকিবুকির মাঝে, বর্ষার ক’টা মাস হাজারি ওঝার দো-চালা বাড়িটা যেন ভরসার দ্বীপ হয়ে জেগে থাকে। সাপে ছুঁলে তিনিই যে শেষ কথা, বাসন্তী-গোসাবায় সে বিশ্বাস ষোলো আনা।

সেই দ্বিজপদ হাজারিই এখন মাথা নেড়ে চলেছেন— ‘‘আর লয় ঝাড়ফুঁক মন্ত্র-চালনা মিথ্যে চিকিস্সা (চিকিৎসা)! রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।’’ কেন? ধুতির খুঁটে মুখটা মুছে হাজারি ওঝা বলছেন, ‘‘সাপের বিষ ঝাড়া ছিল নেশা। তবে কাজটা আন্দাজে ঢিল মারার মতো। বয়স হচ্ছে তো, এখন জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে বড় সঙ্কোচ হয়।’’

শুধু হাজারি ওঝা কেন, দক্ষিণ ভোমরার তাবিল জমাদার, হাড়োয়ার হারান প্রামাণিক কিংবা ঝড়খালির রসুল মিঞা— দুয়ারে সাপে কাটা রোগী এলে ভুরু জোড়া কুঁচকে বলছেন, ‘‘এখানে নয়, হাসপাতালে যাও!’’ গত কয়েক বছরে ঝাড়ফুঁকের মন্ত্রটাই কি ভুলে গিয়েছেন তাঁরা? দ্বিজপদ হাসছেন, ‘‘তা এক রকম ভুলেই গেছি বলতে পারেন। আসলে আমাদের কানে গত কয়েক বছর ধরে ওঁরা যে মন্ত্র ঢেলেছেন, তাতে ঝাড়ফুঁকের মন্ত্র ধুয়ে-মুছে গিয়েছে!’’

‘ওঁরা’ মানে ক্যানিংয়ের যুক্তিবাদী-সংস্কৃতি সংগঠন। শহরের প্রান্তে দু’নম্বর দিঘির পাড়ে নিতান্ত আটপৌরে একটা ঘর। মলিন দরজা ঠেলে ঢুকলে, তাক জুড়ে তাড়া-তাড়া প্যামফ্লেট-লিফলেট আর সর্প দংশনের আশু চিকিৎসার এক গুচ্ছ বই। বেঁটে আলমারিতে এভিএস (অ্যান্টি ভেনম সিরাম), অ্যাট্রোপিন আর নিউস্টিগমিন,
সাপের দাওয়াই।

সংগঠনের সম্পাদক বিজন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘আসলে কী জানেন, শত্রুকে কাছে টেনে নিতে পারলে কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়।’’ গত পনেরো বছর ধরে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ফলও মিলেছে। সুন্দরবনের প্রান্তিক গাঁ-গঞ্জের ডাকসাইটে ওঝা-গুণিনদের অনেকেই এখন নিখাদ ‘যুক্তিবাদী’ হয়ে উঠেছেন। ক্যানিংয়ের সংগঠনটির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন ১৭ জন ওঝা। সাপে কাটা রোগী এলে ঠেলে পাঠাচ্ছেন হাসপাতালে। বলছেন, ‘‘আমাদের মন্ত্রের চেয়েও বেশি ক্ষমতা এভিএস-এর।’’ বিজনবাবুদের সংগঠনের হয়ে দ্বীপ-দ্বীপান্তরে প্রচারেও যাচ্ছেন তাবিল, দ্বিজপদরা। গ্রামবাসীদের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে কবুল করছেন, ‘‘ও সব মন্ত্র-টন্ত্র ধাপ্পা! আমাদের চিকিৎসায় কেউ সেরে উঠলে জানবেন বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছে!’’

কিন্তু বাপ-ঠাকুরদার পেশা ছেড়ে তাঁদের পেট চলছে কী করে? হারান বলছেন, ‘‘আসলে ওঝাদের অধিকাংশই আবাদি মানুষ। কেউ বা দিনমজুর, রিকশা চালক। ওঝার মন্ত্র চালনাটা একটা ‘সাইড বিজনেস’ বলতে পারেন।’’ ঝড়খালির রসুল মিঞা আবার ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘সুন্দরবনের বাদাবনে বহু ওঝা-গুণিন রয়েছেন, যাঁরা পেটের দায়ে কাজটা ছেড়ে আসতে পারছেন না। কিন্তু নিজেরাও জানেন, পেশাটা নিছক বুজরুকি।’’ বিজনবাবুরা প্রত্যন্ত গ্রামের সেই ওঝাদের সঙ্গেও নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলেছেন। সংগঠনের আর এক সদস্য বাবলু সাহু। তিনি বলছেন, ‘‘সরকারি অনুদান তো পাই না, তাই ওঁদের পুরনো পেশা থেকে সরিয়ে এনে যে বিকল্প রুজির পথ দেখাব, সে সুযোগ নেই। নিরন্তর বুঝিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র উপায়।’’

ক্যানিং হাসপাতালের চিকিৎসক সমরেন্দ্রনাথ রায়ও জড়িয়ে গিয়েছেন সংগঠনটির সঙ্গে। বললেন, ‘‘মানুষকে সচেতন করার নিরলস চেষ্টা দেখে ওঁদের পাশে দাড়িয়েছিলাম। এক সময়ে ওঁদেরই এক জন হয়ে পড়েছি। বর্ষায় তো দম ফেলার সময় নেই।’’

বর্ষার মাঝপথেই গ্রামবাংলায় সর্প দংশনের মাত্রাটা বাড়ে। আর প্রতি বছর সাপে কাটায় শীর্ষস্থান দখল করে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। কাছাকাছি থাকে হুগলি, নদিয়া, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর আলিপুরদুয়ার। আপাতত দক্ষিণ ২৪ পরগনার জন্য একটি হেল্পলাইন চালু করেছেন বিজনবাবুরা। অন্যান্য জেলাতেও হেল্পলাইন খোলার চেষ্টা চলছে। চলতি মরসুমেই ৫৩২ জন সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করেছেন তাঁরা। আর অসহায় হাসি খেলে যাচ্ছে দ্বিজপদর মুখে! ‘‘আফশোস হয়, ওই মন্ত্র-টন্ত্র যদি আগেই ছাড়তাম, হয়তো আরও ক’টা মানুষ প্রাণে বাঁচত!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

snake bite
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE