Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ইস্তফা নয়, শত চাপেও উপাচার্য অনড়ই

ছাত্রছাত্রীরা এখনও তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অটল। একই দাবি তুলে রাজপথে মিছিলে হেঁটেছেন একাধিক প্রাক্তন উপাচার্যও। এমনকী স্বয়ং রাজ্যপাল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও উপাচার্যের ব্যাপারে পরোক্ষে অসন্তোষ জানিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও পদ না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অনড়ই রইলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৪৮
Share: Save:

ছাত্রছাত্রীরা এখনও তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অটল। একই দাবি তুলে রাজপথে মিছিলে হেঁটেছেন একাধিক প্রাক্তন উপাচার্যও। এমনকী স্বয়ং রাজ্যপাল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও উপাচার্যের ব্যাপারে পরোক্ষে অসন্তোষ জানিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও পদ না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অনড়ই রইলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। শুধু তা-ই নয়, এক ধাপ এগিয়ে যাদবপুরের আন্দোলনে ‘নেশাড়ুদের উপস্থিতি’ নিয়ে তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যেই সিলমোহর দিয়েছেন তিনি!

রাজভবন সূত্রে বলা হয়, রাজ্যপাল চান সোমবার থেকেই যাদবপুরে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই দিন থেকে যাতে পঠনপাঠন শুরু হয়, সেই বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শনিবার ছাত্র-প্রতিনিধিদলকেও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রবিবার সাধারণ সভা ডেকে পড়ুয়ারা জানিয়ে দেন, উপাচার্য পদত্যাগ না-করা পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে। আজ, সোমবার বেলা ১২টা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করবেন। তার পরে আন্দোলনের পরবর্তী অভিমুখ কী হবে, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

আন্দোলনকারীদের তরফে বলা হয়, “রাজ্যপাল সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দেওয়ায় আমরা শনিবার মেয়ো রোড থেকে অবস্থান তুলে নিয়েছিলাম। সোমবার বেলা ১২টার মধ্যে দাবি মানা হলে আমরা ক্লাসে যাব। অন্যথায় আন্দোলন চলবে।” পড়ুয়ারা জানান, আচার্যের উপরে তাঁদের ভরসা আছে। কিন্তু উপাচার্যকে পদত্যাগ করতেই হবে।

উপাচার্য কিন্তু অনড়ই। অভিজিৎবাবু রবিবার জানান, সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন কি না, ঠিক করেননি। তবে তিনি পদত্যাগ করছেন না। উপাচার্যের কথায়, “রাজ্যপাল পড়ুয়াদের কী পরামর্শ দিয়েছেন, জানি না। আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আমি শুধু আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে পারি।”

উপাচার্য যা-ই বলুন, ছাত্রছাত্রীরা অভিজিৎবাবুর পদত্যাগের যে-দাবি তুলেছেন, এ দিন তা জোরদার করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বিকেলে ঢাকুরিয়া থেকে যাদবপুর পর্যন্ত মিছিল করে শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটা। মিছিলে হাঁটেন তিন প্রাক্তন উপাচার্য, বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। পুলিশ মঙ্গলবার রাতে ছাত্রীদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করা সত্ত্বেও তার তদন্ত হচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্ন তোলেন প্রাক্তন উপাচার্যদের কেউ কেউ। রাজ্য সরকার এবং রাজ্যপালের কাছে পুলিশি হামলার তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দাবি করে শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানান, ছাত্রদের এই আন্দোলনে তাঁরাও সামিল।

যাদবপুরের প্রাক্তনী ও প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু বলেন, “অন্যায় যে-ই করুক, তার শাস্তি হওয়া দরকার। এক জন ছাত্রী লাঞ্ছিত হয়েছেন। তার তদন্ত হবে না? সরকার ও রাজ্যপালকে অনুরোধ, তদন্ত করে শাস্তি দিয়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করুন।” যাদবপুরের আর এক প্রাক্তন উপাচার্য শঙ্কর সেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক যে বন্ধুর মতো, সেই বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে রাজ্যপালকে দ্রুত বিষয়টির নিষ্পত্তি করার আর্জি জানিয়েছেন শঙ্করবাবু।

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য শুভঙ্কর চক্রবর্তী আগাগোড়াই ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে। মিছিলে থাকা এক শিক্ষক বলেন, “অস্থায়ী উপাচার্য চাই না। এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই।” অন্য এক শিক্ষকের কথায়, “ছাত্রদের পথই আমাদের পথ। উপাচার্যের পদত্যাগ চাই।” আনন্দদেববাবু যাদবপুরেরই প্রাক্তনী। তিনি বলেন, “১৯৬৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ঘেরাও হয়। সারা রাত ঘেরাও চলে। ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সুবোধ সেনগুপ্তের মতো মানুষজন। সকালে ঘেরাও ওঠে। কিন্তু কেউ পুলিশ ডাকেনি।”

ওয়েবকুটার তরফে যাদবপুরের অস্থায়ী উপচার্যের কাছে নির্দিষ্ট একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ওই শিক্ষক সংগঠন চায়, অভিজিৎবাবু এখনই পদত্যাগ করুন। স্থায়ী উপাচার্যের বাছাই তালিকায় তাঁর নাম যাতে না-থাকে, সেটাও তিনিই জানিয়ে দিন রাজ্য সরকারকে।

শনিবার কলকাতায় ছাত্রছাত্রীদের বিশাল মিছিল, দিল্লির মিছিল, এ দিনের শিক্ষক মিছিল, বেঙ্গালুরুতে প্রাক্তনীদের মিছিলের পরে আন্দোলনে যে গতি আসবে, এ দিন পড়ুয়াদের কথাতেই সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের কত শতাংশের সমর্থন রয়েছে, তা যাচাই করতে যাদবপুর ক্যাম্পাসে সোমবার থেকে সই সংগ্রহে নামছেন আন্দোলনকারীরা। পরবর্তী কমর্সূচি নিয়ে সাধারণ সভাও করবেন তাঁরা।

এই পরিস্থিতিতে চাপ বাড়াচ্ছে বিজেপি-ও। যাদবপুর কাণ্ড নিয়ে তাঁরা জাতীয় মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলে এ দিন জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ মীনাক্ষী লেখি। মহাজাতি সদনে দলীয় কর্মসূচির অবসরে মীনাক্ষী বলেন, “ছাত্রীর শ্লীলতাহানি, তার প্রকৃত তদন্তের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন এবং প্রতিবাদীদের দমনের চেষ্টা এই তিনটি ঘটনা এক সূত্রে গাঁথা। তাই আমি এ বিষয়ে জাতীয় মহিলা কমিশনকে চিঠি দেব।” আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় জানান, যাদবপুরের আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানাতে সোমবার তাঁর যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে রাজনীতির রং লাগাতে চান না বলে তিনি সেখানে না-গিয়ে দূর থেকে ওই লড়াইকে সমর্থন করছেন। বাবুল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ হিসেবে ওই ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি ওখানে গেলে মনে হবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গেলাম। তাই যাচ্ছি না’।

যাদবপুরের প্রতিবাদ মিছিলে ‘এক বৃন্তের দু’টি ফুল, সিপিএম আর তৃণমূল/আলিমুদ্দিন শুকিয়ে কাঠ, শত্রু এখন কালীঘাট’ জাতীয় স্লোগান প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও যাদবপুরের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষেই সওয়াল করে এ দিন বিবৃতি দিয়েছেন সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সর্বভারতীয় সভাপতি ভি শিবদাসন। ক্যাম্পাসের ভিতরে-বাইরে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের কথা বলেছেন তাঁরা। বহাল রেখেছেন উপাচার্যের পদত্যাগ, শ্লীলতাহানির অভিযোগের যথাযথ তদন্তের দাবিও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE