করিমপুরে ‘লালু’র চপের দোকানে ‘মোদী’। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক
পৌষের সন্ধ্যা। উত্তুরে হাওয়ায় বেশ কনকনে ভাব। রাস্তাঘাটে লোকজন তুলনায় কম। ধীর গতিতে এসে দাঁড়ানো গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। কোনও দেহরক্ষী সঙ্গে নেই। পাশে নেই অমিত শাহ কিংবা অরুণ জেটলির মতো নেতা-মন্ত্রী।
একাই ছাতি টানটান করে এগিয়ে গেলেন দোকানটার সামনে। তার পর আসমুদ্রহিমাচল যে সম্বোধনে এখন চমকে উঠছে, ঠিক সেই ভাবেই তিনি শুরু করলেন, ‘‘মিত্রোঁ...।’’
যাঁর উদ্দেশে সম্বোধন, সেই লালুপ্রসাদ প্রথমে একগাল হাসলেন। তার পর ঝরঝরে বাংলায় জানতে চাইলেন, ‘‘কী দেব, আলু না কলা?’’
নদিয়ার করিমপুর বাজারে চপের দোকানের সামনে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী নয়, দাঁড়িয়ে আছেন অমিতকুমার পণ্ডিত। যাঁকে তামাম করিমপুর এখন মোদীজি বলে ডাকে। জনপ্রিয়তায় রফি-কণ্ঠী, কিশোর-কণ্ঠীদের প্রায় পিছনে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করেছেন এই মোদী-কণ্ঠী।
যাঁর দোকানে দাঁড়িয়েছেন তিনি, সেই জীবন মালাকারকে আবার হুবহু লালুপ্রসাদ যাদবের মতো দেখতে। এতটাই যে, নিজে দোকানে লিখে রেখেছেন ‘নকল লালুপ্রসাদের চপ’। কেউ জীবনবাবু বলে ডাকলেই বরং চমকে ওঠেন তিনি।
এ বার একই শহরে যদি ‘লালু-মোদী’ দু’জনেই থাকেন, তা হলে নোটের নাটক তো জমবেই।
চোস্ত হিন্দিতে মোদীর গলা নকল করে একজন শুরু করবেন— ‘মিত্রোঁ, দেশকো কালা ধনসে বচানে কে লিয়ে ইয়ে সব জরুরত থা। ইয়ে গো-ক্যাশলেস...।’’ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে লালুপ্রসাদ বলবেন, ‘‘আহা, ক্যাশের হিসেব পরে হচ্ছে। আর একটা আলুর চপ দিই?’’
মাঝেমধ্যেই অমিতকে আজকাল লোকজন পাকড়াও করছেন চায়ের ঠেকে। সঙ্গে অনুরোধ, ‘‘মোদীর ওই ডায়ালগটা আর একবার বল না ভাই।’’ গলাটা ঝেড়ে হাসিমুখে অমিত শুরু করছেন, ‘‘মেরে পেয়ারে দেশবাসিয়ো...।’’ কেউ আবার মোবাইলে সেটা রেকর্ড করে ইউটিউব খুলে মেলাচ্ছেন, ‘‘আরিব্বাস! এই দ্যাখ, একই গলা।’’
লালু-অবতারে জীবনবাবুর হিন্দিটা অবশ্য তেমন দড় নয়। তবুও তাঁর জন্যও অনুরোধের শেষ নেই। হাটে-বাজারে, চপের দোকানে এসে লোকে বলছেন, ‘‘কী লালুপ্রসাদ, মমতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন তো?’’ হাসতে হাসতে লালুপ্রসাদ, থুড়ি জীবনবাবুও জবাব দিচ্ছেন, ‘‘নোট বাতিলে ব্যবসাই যখন বসে গিয়েছে তখন না দাঁড়িয়ে আর উপায় কী?’’ রামকৃষ্ণপল্লির এই বাসিন্দা নিজেও লালুপ্রসাদের অন্ধ ভক্ত। বেশ কিছু রোড-শোয়ে জীবনবাবু লালু সেজেছেন। বছরখানেক আগে লালুপ্রসাদের জয়ের পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ‘‘আরজেডি প্রধানের একার নয়, এ জয় করিমপুরের লালুপ্রসাদেরও।’’ বিকেলে পাড়ার ছেলেপুলেদের ডেকে ডেকে চপ-পেঁয়াজি খাইয়েছিলেন। স্ত্রী অনিমাদেবী স্বামীর এই লালু-প্রীতিকে প্রশ্রয়ই দেন। লালুবৎ মেজাজ দেখলেই মুচকি হেসে আলমারি থেকে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি বের করে দেন। বললেন, ‘‘এই নোট বাতিলে চপের ব্যবসা খারাপ চলায় কর্তা মোদীর উপরে বেজায় চটেছেন।’’
মোদীকণ্ঠী অমিতকুমারকে অবশ্য দমানো যায় না সহজে। বছর দেড়েক হল সক্রিয় ভাবে বিজেপি করছেন। করিমপুর পান্নাদেবী কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক অমিত এমনিতে পাটের ব্যবসা সামলান। তাঁর কথায়, ‘‘মোদীকে ভালবেসেই বিজেপিতে এসেছি। টিভি, রেডিওতে মোদীর কোনও অনুষ্ঠান বাদ দিই না।’’ সেখান থেকেই মোদীর কায়দায় কথা বলা রপ্ত করেছেন অবাঙালি ওই যুবক। এখন বিজেপির সভাসমিতিতে তিনিই লোক টানার কারিগর।
‘মোদী’কে কাছে পেয়ে চপ খাইয়েছেন ‘লালুপ্রসাদ’। সেই সঙ্গে উগরে দিয়েছেন নিজের ক্ষোভও। বলেছেন, ‘‘দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে, সে তো ভাল কথা। কিন্তু মোদীজি, আমার তেলেভাজা শিল্প যে পথে বসার জোগাড়। দৈনিক বিক্রি তিন হাজার থেকে নেমে এসেছে এক হাজারে।’’
মোদীও আশ্বাস দেন, ‘‘পরিস্থিতি দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখবেন, চপও ই-পেমেন্টে বিক্রি হচ্ছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy